সেলজুক তুর্কিরা আব্বাসী আমলে যে অবদান রেখেছেন তা আলোচনা কর
সেলজুক তুর্কিরা আব্বাসী আমলে যে অবদান রেখেছেন তা আলোচনা কর |
সেলজুক তুর্কিরা আব্বাসী আমলে যে অবদান রেখেছেন তা আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : ইসলামের ইতিহাস পঠন-পাঠনে যে সকল শাসক বংশের নাম খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়, তার মধ্যে সেলজুক বংশ অন্যতম।
সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনীর ধ্বংসাবশেষের উপর সেলজুক শক্তি ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেলজুকগণ মধ্যে এশিয়ার বিখ্যাত তুর্কি গোত্রীয় ঘুজ বংশোদ্ভূত ছিলেন।
একজন পূর্ব পুরুষ সেলজুক-বিন-রাকায়িকের নামানুসারে এ বংশের নামকরণ হয় সেলজুক বংশ। একাদশ শতাব্দীতে সেলজুকগণ তুর্কিস্থানের কিরগিজ মালভূমি থেকে তারা সাইহুন নদী অতিক্রম করে দক্ষিণ ট্রান্স অক্সিয়ানার বুখারায় এসে বসতি স্থাপন করে।
তুর্কিস্থান থেকে দক্ষিণ নিম্ন, অক্সিয়ানার কাছে বসতি স্থাপন করেন। কালক্রমে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুন্নি মতবাদের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেন। কাল প্রবাহে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
ইসলাম ও খিলাফতের সেলজুকদের অবদান : ইসলামের ইতিহাসে সেলজুক তুর্কিদের অভ্যুত্থান একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ যুগের সূচনা করেছিল।
নিম্নে সেলুকদের বিভিন্ন অবদান আলোচনা করা হলো :
১. সুন্নি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা : সেলজুক তুর্কিদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান সুন্নি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা। আব্বাসীয় শাসনামলে শিয়াদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে সুন্নি ধর্মমত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
আর ঠিক এ সময় শিয়া সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ট্রান্স অক্সিয়ানায় সেলজুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। সেলজুক শাসনামলে আব্বাসীয়দের নামে খুত্বা পাঠ করা হতো। প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্নি ধর্মমত।
২. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা : সেলজুকদের বড় অবদান ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা। প্রত্যেক সেলজুক সুলতান শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
তবে সুলতান মালিক শাহের সময়ে সাম্রাজ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তৃত ঘটেছিল। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক ও জ্যোতির্বিবিদগণের পদচারণায় মালিক শাহের রাজ দরবার ছিল মুখরিত।
তার শাসনামলে বলথ, তারবারিস্থান, হামাদান ও ইস্পাহানে ইসলামী শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে মাদ্রাসা ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে ইসলাম প্রচার ও দীন শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
৩. সাম্রাজ্যের সুসংহতকরণ : সেলজুক শাসনামলের শুরুতে সাম্রাজ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খল হলেও, সুলতান মালিক শাহ এবং আলপ আরসালানের সময়ে সেলজুক সামাজ্যের সুসংহত হয়।
পূর্বে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরীয় পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া থেকে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতি লাভ করে। বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি সাম্রাজ্যের সুসংহতকরণ এবং শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন ।
৪. স্থাপত্য শিল্পে অবদান : সেলজুক সাম্রাজ্যের সময় স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটে। লেল্লুক সুলতান মরিক শহ স্থাপত্য শিল্পের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যে অসংখ্য মসজিদ ও ইমারত নির্মান করেন।
তার সময়ে ইস্পাহান মসজিদ, বিসতাম আরদিস্তান, জাওয়ারা ও গুলপাইন প্রভৃতি অসংখ্য মসজিদ ও মিনার নির্মিত হয়। ফলে ইসলামী স্থাপত্যশিল্প বিকাশ লাভ করে ।
৫. নিজামের সিয়াসাতনামা : নিজামুল মুলকের বিখ্যাত গ্রন্থ “সিয়াসতনামা' (Syasat Nama) রাজ্য শাসন গুণাবলির উপর লিখিত একটি গবেষণামূলক রচনা।
এ বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করা হয় সেলজুক শাসনামলে। সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে তার প্রধানমন্ত্রী ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থটি রচনা করেন, এটি ইসলামি শাসন ব্যবস্থার উপরও একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এ গবেষণামূলক গ্রন্থ সম্পর্কে ঐতিহাসিক আরনল্ড বলেন, গ্রন্থটি শুধু “রাজনৈতিক নীতিমালা সম্বলিত একটি দার্শনিক নিবন্ধই ছিল না, বরং এটিতে শাসন প্রণালি, দরবার বিচারকার্য, সামরিক বিভাগ এবং অর্থনৈতিক ও রাজনেতিক কার্যাবলির উপর ব্যবহারিক উপদেশ প্রদান করা হয়।” এটিতে রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও প্রদান করা হয়।
৬. সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় : বিদ্যোৎসাহী নিজাম শিক্ষা সম্প্রসারণ করে বাগদাদে ১০৬৫-১০৬৭ খ্রিস্টাব্দে নিজামিয়া মাদ্রাসা নামে ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন।
জ্ঞানবৃদ্ধ তাপস নিজাম কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত ইসমাঈলী শিক্ষায়তনে আল-আজহারের প্রতিদ্বন্দ্বী বাগদাদে ধর্মীয় শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সাফেয়ী এবং আশায়ারী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
সেলজুক শাসনামলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। সাম্রাজ্যে নিজামিয়ার মর্যাদা এবং প্রভাব সর্বাধিক ছিল।
এর কারণ ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক এবং চিন্তাবিদ গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.) এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। উপরন্তু মহাকবি শেখ সাদি ও এই মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন।
৭. জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশ : নিজামুল মূলকের পরামর্শে মালিক শাহ ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে একটি জ্যোতির্বিদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং এই সম্মেলনে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
নিশাপুরে একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক কবি সাহিত্যিক জ্যোতির্বিদ এবং অঙ্কশাস্ত্র বিশারদ ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীগণ পারস্যের বিজ্ঞান সংস্কারে মনোনিবেশ করেন।
৮. জালালি পঞ্জিকা তৈয়ারিকরণ : সেলজুক শাসনামলের অন্যতম অবদান জালালি পঞ্জিকা প্রস্তুতকরণ। অঙ্কশাস্ত্রের বিশারদ ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীগণ জালালি পঞ্জিকা তৈয়ারিকরণে সিদ্ধান্ত নেয়।
এ সময় তারা চন্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস অনুযায়ী গণনার প্রথা চালু করেন। প্রচলিত পদ্ধতির যাবতীয় ভুলগুলো সংশোধন করে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন।
মালিক শাহ জালাল-উদ্-দৌলাহর নামানুসারে এর নাম দেওয়া হয় “জালালী পঞ্জিকা (Jalali Calendar)। জালালি পঞ্জিকা বর্তমানে প্রচলিত পঞ্জিকা পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি সূক্ষ ও নির্ভুল ছিল।
ঐতিহাসিক গিবন বলেছেন, “এটি জুলিয়ান পঞ্জিকা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং গ্রেগরি পঞ্জিকার নির্ভুলভাবে সমকক্ষতা দাবি করেন।”
৯. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি : সেলজুক স্থাপত্য-শিল্প, পোড়া মাটি ইট এবং কারুকার্য খচিত মসজিদ, মিনার ও মাদ্রাসায় মূর্ত হয়ে রয়েছে।
সেলজুকদের ধর্মীয় অনুরাগ এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনা পারস্য হতে উদ্ধৃত তারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র ইসলামি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।”
খলিফা হারুন- অর-রশিদ ও মামুনের মতো সেলজুক শাসকরা হজযাত্রী, বণিক ও পরিব্রাজকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রহরার ব্যবস্থা এবং আরাম আয়েশের জন্য বিশ্রামাগারে বা সরাইখানা নির্মাণ করেন। এ সময়, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রভৃতি উন্নতি সাধিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুন্নি ইসলামের রক্ষক এবং প্রচারক সেলজুক বংশ এশিয়া মাইনরে বাইজান্টাইনের আধিপত্য ধ্বংসপূর্বক মুসলিম প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে একদিকে যেমন অটোমান সালতানাতের আবির্ভাব ত্বরান্বিত হয়, অপরদিকে খ্রিস্টানদের পরাভূত করে ধর্মযুদ্ধের প্রেরণা লাভ করতে সহায়তা করে।
এ বংশ আব্বাসীয় খিলাফতকে নিরাপত্তা বিধানে 'অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। ঐতিহাসিক ফার্নিবাম বলেন, “এশিয়ার মাইনরে অভিযান এবং প্রথম ক্রুসেডে তারা জড়িত হওয়ার ফলে পাশ্চাত্যে সেলজুকদের সুষ্ঠুরূপে স্মরণ করা হয়। মুন্নি ইসলামের পুনর্জীবন কালে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে মুসলমানগণ প্রেরণা লাভ করে।"