সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে গুপ্তঘাতকদের কার্যাবলি আলোচনা কর
সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে গুপ্তঘাতকদের কার্যাবলি আলোচনা কর |
সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে গুপ্তঘাতকদের কার্যাবলি আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে গুপ্তঘাতকদের কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : যে সকল সম্প্রদায় ইসলামের ইতিহাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রপ্তঘাতক সম্প্রদায়। ইতিহাসে নাস্তিকবাদী গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উত্থান একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে।
সেলজুক সুলতান মালিক শাহের শাসনামলে এ ত্রাস সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই হত্যাকারী গোষ্ঠী নিজামুল মুলকের সহপাঠী হাসান বিন সাবাহ এর দ্বারা স্থাপিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তার সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রভূত বিস্তারলাভ করতে সক্ষম হয়।
হাসান বি| সাবাহ রাজ্যজয় করতে না পেরে ধ্বংসাত্মক কার্যাবলি পরিচালনা করেছিলেন এতে সুন্নি সম্প্রদায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
→ গুপ্তঘাতকদের পরিচয় : হাসান বিন সাবাহের নেতৃত্বে ইসমাঈলীয় শিয়াদের যে দল ইরান ও সিরিয়াতে গুপ্ত- হত্যাকাণ্ডের সংঘটিত করত তারাই ইসলামের ইতিহাসে গুপ্তঘাতক নামে পরিচিত।
১০৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে তারা পারস্যের অন্তর্গত মাজেন্দ্রান গিরিসঙ্কটে অবস্থিত আলামুত দুর্গ অধিকারের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে।
গুপ্তঘাতকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেলজুক সুলতানদের গুপ্তহত্যার দ্বারা ধ্বংস করা। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হাসান বিন সাবাহ।
আলমুত দুর্গ দখল করে তারা ইয়াজিদ, কিরমান, দামগানসহ বিভিন্ন অধওল দখল করে। হালাকু খান এ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন।
১. হাসান বিন সাবাহের জন্ম ও পাণ্ডিত্য : হাসান-বিন-সাবাহের পুরো নাম ছিল আল-হাসান বিন আলী মুহাম্মদ ১০৫০ সালে কুম অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী হাসান বিন সাবাহ খুবই মেধাবী ছিলেন।
সাত বছর বয়সে বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ করে সতের বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র দশ বৎসরে তিনি অঙ্ক, পাটীগণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১১২৪ সালে তিনি মারা যান।
২. হাসান বিন সাবাহর ইসমাঈলী মতবাদ ; প্রচার প্রতিশোধ গ্রহণের সহজপথ হিসেবে ইবনে সাবাহ মুমিন নামক একজন ফাতেমী প্রচারকের নিকট ইসমাঈলী বা ফাতেমী মতবাদ গ্রহণ করেন।
মুমিন হাসান বিন শাহকে আজারবাইজানের প্রধান ফাতেমী প্রচারক শায়খ আহমদ এর নিকট উপস্থিত করে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। শায়ক আহমদ-এর পরামর্শে হাসান বিন সাবাহ ইসমাঈলী মতবাদ প্রচার করেন।
৩. নিজামুল মুলক ও সাবাহের মাঝে জন্ম : ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যেন চির ইতিহাস থেকে বয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় হাসান বিন সাবাহ এবং নিজমুল মূলকের মাঝে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
আতা মালিক, রশীদ আলাদীন, আল দাওয়াবী প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, প্রথম জীবনে নিজামুল মুলক শেখ সাদী, ইবনে সাবাহ তিনজন সহপাঠী ছিলেন এবং তাদের মাঝে প্রতিশ্রুতি ছিল এই যে, তিনি জীবনে বেশি ভাগ্যবান হবেন তিনি অপর দুইজনকে প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবেন।
পরবর্তীতে নিজামুল মুলক সেলজুক সুলতান মালিক শাহের প্রধান উজির হয়ে দুই বন্ধুকে প্রাদেশিক প্রশাসক পদ প্রদান করেন।
শেখ সাদী দায়িত্বমুক্ত হিসেবে ভাতা প্রাপ্তি সম্রষ্ট হলেও হাসান বিন সাবাহ মন্ত্রীত্ব দাবি করার নিজামুল মূলক-এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। নিজাম মুলক সাবাহকে দরবারে অপমান করলে উভয়ের মাঝে দ্বন্দ্বের বীজ রোপিত হয়।
৪. হাসান বিন ইবনে সাবাহ কর্তৃক গুপ্তঘাতক দল গঠন : ইবনে সাবাহ প্রত্যাবর্তন করে ফাতেমী প্রচারক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু তিনি নীতি ও পদ্ধতিগত বিষয়ে নতুন কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
আব্বাসীয় খিলাফত ও সেলজুক সুলতানদের ধ্বংস সাধনের জন্য তিনি গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় তথা গুপ্তহত্যার আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্য তিনি একটি গুপ্তঘাতক দল নিযুক্ত করেন।
৫. ফিদারীয়দের গঠন প্রণালি : হাসান বিন সাবাহ সৈনিক পেশায় উৎসাহী বার থেকে বিশ বৎসর বয়স্ক মুবকদের ফিদায়ী বাহিনীতে ভর্তি করেন। অতঃপর তাদেরকে সর্বোচ্চ কষ্টসহিষ্ণু করে তোলা হতো।
তাদের ধর্মমতের গুপ্তরহস্য সম্পর্কে তারা কিছু না জানলেও সকল প্রকার অস্ত্রচালনা, জন্মবেশ ধারণ, সকল শ্রেণির লোকদের সাথে উঠা বসার যোগ্যতা, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য ভাষার জ্ঞান দান, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টানদের আচার অনুষ্ঠানে অভিজ্ঞতা প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা হয়।
৬. হাসান বিন সাবাহর প্রচারকদের শ্রেণিবিভাগ : গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় পরিচালনার ক্ষেত্রে হাসান বিন সাবাহ খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। মর্যাদা ও দায়িত্বের ভিত্তিতে হাসান বিন সাবাহ তার প্রচারক দলকে পৃথক ছয়টি ভাগে ভাগ করেন। তা হলো-
(i) দায়ী আল দোয়াত,
(i) শায়খ আল জাবাল এর জেলা প্রতিনিধি দায়ী আল কবীর বা শ্রেষ্ঠ প্রচারক,
(ii) দায়ী আল কবীরের অধীনস্ত কতকগুলো দায়ী বা সাধারণ প্রচারক,
(iv) দায়ীদের সহযোগিতার জন্য কিছু সংখ্যক রফিক।
(v) রফিকদের সাথে কিছু সংখ্যক অনুসারী বা লামীক
(vi) শেষে ছিল আত্মউৎসর্গকারী ফিদারী দল। মূলত ফিদারীরাই ছিল প্রকৃত গুপ্তঘাতক দল।
৭. ইবনে সাবাহর রাজ্য বিজয় : রাজ্য বিষয় এবং হাসান বিন ইবনে সাবাহ ছিল অধিক মনোযোগী। আলমুত দুর্গ দখল করে দৃঢ়তার সাথে ইয়াদদ, কিরমান, তাবারিস্তান, দামগান প্রভৃতি অঞ্চলের উপর অধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি এর সাথে সাথে শাহজীদ গীরন ই-কহ, কিনায়াতুল নাদীর এবং বুর খালাত খান প্রভৃতি দুর্গ দখল করেন।
৮. গুপ্তঘাতকদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড : হাসান বিন সাবাহ ও ফিদারীদের দ্বারা হত্যা করেছিলেন পশ্চিম এশিয়ার বহু গণ্যমান রাজপুরুষ, মন্ত্রী, পণ্ডিত ও রাজকুমারকে, এমনকি কয়েকজন ক্রুসেড রাজাও তাদের হাতে নিহত হয়।
এভাবে তাদের হাতে নিহত হন সে যুগের শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত মুসলিম মন্ত্রী নিজামুল মুলক। সুলতান বায়কিয়ারুকের মাতার মন্ত্রী আব্দুর রহমান, আল-সুমায়ারী-জালাল উদ্দৌলাহ, উলক বুলকা, কাজী আবুল আল-সায়ীদ, নিজামুল মুলকের ফাখরুল মুলক, মাউদুদ, বাগদাদের আহ্বান বিন ওয়াহসুদান ফাতেমী খলিফা আর আমীর বি আমাবিল্লাহ, আব্বাসীয় খালিফা মুআতারিশা এবং সুলতান সমজারের অতিপ্রিয় সভাসদ জাওহার ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মাধ্যমে বলতে পারি, হাসান বিন সাবাহর সৃষ্ট ফিদায়াদের লুটতরাজ, লুণ্ঠন ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির পৃথিবীতে কমই আছে।
বৈধ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের অবৈধ কার্যাবলি পরবর্তীকালে মারাত্মক প্রতিহিংসার জন্ম দিয়েছিল। মূলত হাসান বিন সাবাহর কর্তৃক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় ইসলামের ইতিহাসে একটি জঘন্যতম অধ্যায় সৃষ্টিকারী।
যার ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এই সম্প্রদায়ের আঘাতে মৃত্যুরকোলে ধাবিত হতে হয়েছে। মুলত সেলজুক সুলতান মালিক শাহের সময় এদের শান্তি বৃদ্ধি পায় ।