সেলজুক বংশের উত্থান ও পতনের কাহিনি বর্ণনা কর
সেলজুক বংশের উত্থান ও পতনের কাহিনি বর্ণনা কর |
সেলজুক বংশের উত্থান ও পতনের কাহিনি বর্ণনা কর
উত্তর : ভূমিকা : এগারো শতকের মধ্যভাগে বাগদাদে আব্বাসীয় খিলাফতে সেলজুকদের উত্থান একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রত্যেক জাতি বা বংশের নামের পেছনে তাদের পূর্ব পুরুষদের কারও বিখ্যাত নাম সংযুক্ত থাকে।
তেমনি পূর্ব পুরুষ সেলজুক-বিন-বাকায়িকের নামানুসারে উক্ত বংশের নামকরণ হয়েছে সেলজুক বংশ। তারা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবন দান করেন এবং সাম্রাজ্যের একতা ও সংহতি আনয়ন করেন। পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অগ্রাভিযানের কারণে তাদের পতন ঘটে।
সেলজুকদের পরিচয় : সেলজুকদের উত্থান ইসলামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মধ্য এশিয়ায় সেলজুকের আদি বাসস্থান ছিল। মূলত তারা কিরগিজ তুন্দ্রা অঞ্চলের তুর্কি গোত্রীয় ঘুজ (Ghizz) বংশোদ্ভূত তুর্কিস্তানের উপজাতি।
তারা ৯৫৬ সালে সেলজুক-বিন-বাকায়িক নামে এক সেনাপতির নেতৃত্বে তুর্কিস্তানের কিরগিজ মালভূমি থেকে সায়হুন নদী অতিক্রম করে দক্ষিণ ট্রান্সঅক্সিয়ানার বুখারায় এসে বসতি স্থাপন করেন।
কালক্রমে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী হন। সেলজুক বিন বাকায়িকের নামানুসারে এ বংশের নামকরণ করা হয় সেলজুক বংশ। ১১৯৪ খ্রিস্টব্দে পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের সেবা করেছিল সেলজুক রাজবংশ।
→ সেলজুকদের উত্থান : সেলজুকদের উত্থান ইসলামের ইতিহাসে এক বৈচিত্র্যময় ঘটনা। সেলজুকদের উত্থানের ঘটনাবলি নিচে আলোচনা করা হলো :
১. গজনী রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্ব ও আত্মরক্ষা : গজনীর সুলতান মাহমুদ তার সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অর্থাৎ পূর্ব পারস্যে সেলজুকদের উত্থানে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তাদের প্রতিরোধ করেন। এ সময় আত্মরক্ষার্থে সেলজুকরা আজারবাইজানে চলে যান।
পরবর্তীকালে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তার দুর্বল পুত্র ও উত্তরাধিকারী মাসুদের রাজত্বকালে গজনী বংশ দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হলে, সেলজুকরা আবারও পারলো ফিরে আসেন।
২. হিস্টের যুদ্ধে জয়লাভ : গজনীর অধঃপতনের সুযোগে সেলজুকরা প্রাচীন ইলখানি ও সামানী রাজ্যের অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে গজনী রাজ্যে হানা দেয়। এ সময় তারা খোরসানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হন।
১০৩৭ সালে তারা গজনীর সুলতান মাসুদকে হিপ্টের যুদ্ধে পরাজিত করেন। অতঃপর সেলজুকগণ তাদের আদি নেতা সেলজুকের পৌত্র ভূমিল বেগকে দলপতি নির্বাচিত করেন।
৩. তুমিলের রাজ্য বিস্তার : সেলজুক পৌত্র ভূমিল বেগ ছিলেন দুর্ধর্ষ সাহসী যোদ্ধা এবং অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী একজন নেতা।
দলপতি নিযুক্ত হয়ে তিনি তার ভ্রাতার সহযোগীতায় ১০৪০ সালে গজনীর সুলতানকে মার্কের নিকট পরাজিত করে নিশাপুর দখল করেন।
৪. খলিফার আমন্ত্রণে ভূমিলের বাগদাদ অভিযান : তুমিলের মধ্যে সামরিক শক্তি ও প্রতিভার সন্ধান পেয়ে ১০৫৫ সালে দুর্বল আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইম বিল্লাহ তাকে বাগদাদে ডেকে পাঠান।
মূলত বুয়াইয়া আমিরের প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে অতিষ্ঠ হয়েই অগ্নিলকে বাগদাদে ডেকে পাঠান। খলিফার আমন্ত্রণে তুমিল দুর্ধর্ষ তুর্কি বাহিনী নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হন।
৮ ডিসেম্বর তিনি বাগদাদে প্রবেশ করে বুয়াইয়া আমির মালিক আল রহিমকে পরাজিত করেন। এ সময় খলিফা তাকে পরিত্রাণ কর্তা হিসাবে রাজদরবারে সাদরে আমন্ত্রণ জানান।
৫. আল-বাসাগিরির বিদ্রোহ দমন : ভূমিল বাগদাদে আগমনের পূর্বে আল-বাসাসিরি নামক জনৈক তুর্কি নেতা বুয়াইয়া আমির মালিক আল-রহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে আমির উল উমরাহ বলে ঘোষণা করেন।
তাকে বিতারিত করা হয়। কিন্তু ভূমিলের বাগদাদ ত্যাগের পর আল-বাসাগিরি পুনরায় বাগদাদে এসে আব্বাসীয় খলিফার স্থলে মিসরের ফাতেমীয় বংশের খলিফা আল মুসতাসির বিল্লাহকে বাগদাদের খলিফা বলে ঘোষণা করেন। এ সংবাদ পেয়ে ভূমিল দ্রুত বাগদাদে ফিরে এসে বাসাসিরিকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
৬. তুমিলের সুলতান উপাধি লাভ : আল-বাসাসিরিকে হত্যার পর আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইম বিল্লাহ সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন এবং এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ভূমিলকে সমগ্র মুসলিম জাহানের কর্তৃত্ব দান করেন।
তিনি তাকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন। সুলতান হিসাবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও ভূমিল খলিফাকে শ্রদ্ধা করতেন।
৭. মার্তে প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠা : খলিফার সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য তুমিল বাগদাদের পরিবর্তে মার্চে তার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন।
তিনি অঞ্চলের পর অঞ্চল জয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তে উপনীত হন এবং সম্রাটকে কর প্রদানের নির্দেশ দেন।
১০৩৭-১০৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সগৌরবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সেলজুক বংশের আদি পুরুষ সেলজুক বিন বাকায়িকের নামানুসারে এ বংশের নামকরণ করা হয় সেলজুক বংশ।
সেলজুকদের পতন : ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিয়ামের শাসনকর্তা পারস্যে সেলযুকদের ও ওসমানীয় সুলতানগণ এশিয়ার মাইনরের সেলজুকদের পতন ঘটান। নানাবিধ কারণে সেলজুকদের পতন ঘটে।
নিম্নে পতনের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. দুর্বল উত্তরাধিকারী : সেলজুকদের পরবর্তী সুলতানদের দুর্বলতা, অযোগ্যতা, অক্ষমতা, অকর্মণ্যতা তাদের পতনের অন্যতম কারণ। মালিক শাহের মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্যের দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
২. অভ্যন্তরীণ কলহ : মালিক শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের দাবি নিয়ে গৃহযুদ্ধ সূচনা হয়। ক্ষমতা লাভের জন্য অন্ত দ্বন্দ্বের কারণে তাদের পতন হয়।
৩. গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় : মালিক শাহের রাজত্বের শেষে দিকে নিজামুল মুলকের অন্তরঙ্গ বন্ধু হাসান বিন সাবাহ কর্তৃক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ছিল সেলজুকদের পতনের অন্যতম কারণ। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় প্রধানমন্ত্রী নিজামুলকে হত্যা করে সেলজুক বংশের অশেষ ক্ষতি সাধন করে।
৪. আমির ও সেনাপতিদের স্বাধীনতা ঘোষণা : পরবর্তী সেলজুক সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে সেলজুক আমির ও সেনাপতিগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে সেলজুক বংশ আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
৫. ডাকাশের অভ্যূদয় : সেলজুক বংশের পতনের একটি অন্যতম কারণ হলো ডাকাশের অভ্যুদয়। সেলজুকদের দুর্বলতার সুযোগে খাওরাজিমের শাসনকর্তা ডাকাশ ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে পারসিক ইরাকের শেষ সুলতান ভূমিল বেগকে আক্রমণ করলে তাদের পতন হয়।
৬. অর্থনৈতিক অভাব : গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উপদ্রব, সীমান্তে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে সেলজুকদের অনেকাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে পরবর্তীতে সেলজুকদের পতনের পথ সম্প্রসারিত হতে থাকে।
৭. সেলজুকদের পক্ষবিভক্ত : গৃহযুদ্ধের ফলে সেলজুকগণ পাঁচভাগে বিভক্তি হয়ে পড়েন। ফলে তাদের শক্তি ও মর্যাদা বহুলাংশে হ্রাস পায়। পাঁচটি ভাগ হচ্ছে-
(ক) কিরমান সেলজুক,
(খ) সিরিয়া সেলজুক,
(গ) রোমের সেলজুক,
(খ) পারসিক ইরাক সেলজুক ও
(৬) আদি সেলজুক
সেলজুকদের ঐক্য বিনষ্ট হলে এ সুযোগে বিভিন্ন আমীর ও সেনাপতিগণ স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার : উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সেলজুকপণ আব্বাসীয় খিলাফতের এক যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়ে আব্বাসীয় খিলাফতের এবং সুন্নি ইসলামকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
কিন্তু আত্মকলহর কারণে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে তারা নিজেদের আর রক্ষা করতে পারেনি। তাদের পতনে ইসলামি জগতে আরো দুর্দিন নেমে আসে।