সালাহউদ্দিনের পরিচিতি বিস্তারিতভাবে লিখ
সালাহউদ্দিনের পরিচিতি বিস্তারিতভাবে লিখ |
সালাহউদ্দিনের পরিচিতি বিস্তারিতভাবে লিখ
- অথবা, সালাহউদ্দিনের পরিচিতি বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ইসলামের ইতিহাস পঠন-পাঠনে যেসকল বিষয় খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয় তার মধ্যে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক আইয়ুবী বংশের প্রতিষ্ঠা অন্যতম।
ইহা এমন একটি বিষয় যা বিশ্বজনীন এক ঘটনা। আইয়ুবী বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত রিয়েছেন।
যাদৃশ শতাব্দীতে ক্রুসেডারদের বারবার আক্রমণের হাত থেকে তিনি মুসলমানদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম রক্ষা করেন।
ইউরোপের খ্রিস্টানদের আক্রমণে পশ্চিমে এশিয়া হতে ইসলাম যখন নিশ্চিত হওয়ার পথে তখন তিনি ইসলামের গৌরব ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
→ সালাহউদ্দিনের পরিচিতি : নিম্নে প্রশ্নালোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. জন্মগ্রহণ : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত তিনরীত নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।
২. মূলনাম ও বংশ পরিচয় : তার মূলনাম সালাহউদ্দিন ইউসুফ। পিতার নাম নাজিমুদ্দিন আইয়ুবী। পিতার নামানুসারে বংশের নাম আইয়ুবী রাখা হয়। তার পিতা-মাতা উভয়েই কুর্দি ছিলেন।
৩. রাজনৈতিক জীবন : ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি কর্তৃক মিশরীয় ফাতেমীয় খলিফা আল আজিজের - সাহায্যে প্রেরিত আসাদুদ্দিন শিরকুহ -এর নেতৃত্বাদীন মিশরীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।
৪. মালিক-উন-নাসির : মিশরের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি শিরকুহ ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। এ সময় খলিফা আল আজিজ তাকে মালিক-উন-নাসির উপাধি প্রদান করেন। এর আগে নুরুদ্দিন জঙ্গি তাঁকে আমির- উল-আসফাহ উপাধি প্রদান করেন।
৫. সার্বভৌমত্ব : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দু'বছর মিশরের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমীয় খলিফা আল আজিজ মারা যান। এর পর সালাহউদ্দিন স্বীয় সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেন।
৬. আইয়ুবী বংশ : ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিনের প্রথমকর্তা নুরুদ্দিন জঙ্গি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন।
৭. ইন্তেকাল : তৃতীয় ক্রুসেডের সমাপ্তির পর ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ইন্তেকাল করেন।
→ সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর চরিত্র : নিম্নে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর চরিত্র তুলে ধরা হলো :
১. ধর্মপরায়ণতা : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহতীক একজন শাসক। তিনি যুদ্ধের ময়দান উটের পিঠে উপবিষ্ট অবস্থায় নামায আদায় করতেন এবং প্রজাদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
২. স্বাভাবিক জীবন : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী অত্যন্ত নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতেন। প্রচুর ধন-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পরিবরে মতো জীবন যাপন করতেন।
৩. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি ধার্মিক ও জন লোকদের শ্রদ্ধা করতেন। তার রাজদরবারে পণ্ডিত ব্যক্তিদের আলাদা মর্যাদা ছিল।
৪. উজ্জ্বল মন্ত্রীসভা : সালাহউদ্দিন তার মন্ত্রীসভাকে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সমন্বয়ে সুসজ্জিত করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আল কাতিব, ইমামুদ্দিন, আলকাজ আল ইস্পাহানি প্রমুখ।
৫. প্রজাবৎসল শাসক : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের বিপদে বা যে-কোনে ডাকে তিনি সহজেই সাড়া দিতেন।
প্রজাদের নিপীড়ন নয়, প্রজাদের পালনই ছিল তার শাসনের মূলনীতি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন দরিদ্রদের বন্ধু। কেউ প্রয়োজনে আর্তনাদ করলে তাতে সাড়া দিতেন।
৬. দরিদ্রের বন্ধু : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন দরিদ্রদের বন্ধু। প্রজাদের কোনো প্রয়োজনে তিনি সহজেই সাড়া দিতেন।
৭. মহানুভবতা : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন মহানুভব, বদান্যতা, উদারতা মানবতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
৮. মানবতা বোধ : গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মানবতাবোধের কাছে ইউরোপের ইতিহাস লজ্জিত হয়ে পড়ে। ইউরোপ যখন প্রথম মুসলমানদের কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে তখন মুসলমানদের রক্তের বন্যা বয়ে গেছে।
অথচ সালাহউদ্দিন সুশৃঙ্খলভাবে শান্তিপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে জেরুজালেম দখল করেন। এ সময় শুধু বিশ্বাসঘাতক নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়।
৯. মানবকল্যাণ : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মানবকল্যাণের জনহিতকর অনেক কার্যাবলি পরিচালনা করেছেন। যা তার মানবতাবোধের প্রমাণ বহন করে।
- সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কৃতিত্ব : সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. হিত্তিনের যুদ্ধ : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সামরিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৩ জুলাই শুক্রবার হিত্তিনের যুদ্ধে সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের শোচনীভাবে পরাজিত করেন।
২. জনাহতকর কর্যক্রম : সুলতান সালাহউদ্দিন সাম্রাজ্যের অনেক জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করেন। তিনি রাজ্যের সর্বত্র রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ নির্মাণ করে জনসাধারণের প্রীতি ও শ্রদ্ধা লাভ করেন । কৃষিক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য ।
৩. তৃতীয় ক্রুসেড ও তাঁর কৃতিত্ব : জেরুজালেম পতনের পর ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড, জার্মানির রাজা ফ্রেডারিক বারবারোসা এবং ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাষ্টান তৃতীয় ক্রুসেড পরচালনা করেন।
ফ্রেডারিক একটি সিলিসিয়ান নদীতে ডুবে মারা যান। রিচার্ড ও অগাস্টাস প্রাণপণ চেষ্টা করেও জেরুজালেম উদ্ধার করতে পারেনি। পরে দুঃখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন।
৪. আকসা মসজিদে আযান : সালাহউদ্দিন হিত্তিনের যুদ্ধের পর জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে দৃঢ় সংকল্প হন। এক সপ্তাহ পর্যন্ত জেরুজালেম অবরুদ্ধ রাখেন।
অবশেষে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ক্রুসেডাররা আত্মসমর্পণ করেন এবং আকসা মসজিদে পুনরায় আযানের ধ্বনি শোনা যায়।
৫. বীর যোদ্ধা : সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেন। শ্রেষ্ঠবীরের মর্যাদা লাভ করায় তাকে গাজী উপাধি দেওয়া হয়।
৬. স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক : সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি অসংখ্য মাদ্রাসা, এতিমখানা, সুসজ্জিত, মসজিদ নির্মাণ করেন এবং এগুলোকে নানাভাবে সুসজ্জিত করে তোলেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ইসলামের ইতিহাসের অন্যন্য এক নাম। তিনি স্বীয় যোগ্যতাবলে কৌশলে একটি বিখ্যাত রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
ইউরোপের খ্রিস্টানদের আক্রমণের হাত থেকে মুসলমানদের গৌরব ফিরিয়ে আনতে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় । তিনি নিজ যোগ্য বলে অসংখ্য রাজ্য জয় করেন।
বারবার ক্রুসেডারদের প্রতিহত করেন। ইসলামের বিজয় সমুন্নত রাখেন। ইসলামের ইতিহাসে তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে ।