স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিমের শাসনকাল বর্ণনা কর


স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিমের শাসনকাল বর্ণনা কর
স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিমের শাসনকাল বর্ণনা কর

স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাসিমের শাসনকাল বর্ণনা কর

  • অথবা, মীর কাসিমের শাসনকালের বর্ণনা দাও ৷

উত্তর : ভূমিকা : মীর জাফরের পদচ্যুতির পর ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মীর কাসিম বাংলার মসনদে বসেন। মীর কাসিম ছিলেন মীর জাফরের জামাতা। 

কিন্তু তিনি শ্বশুরের ন্যায় অযোগ্য ও অপদার্থ ছিলেন না। মীর কাসিম ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক। 

সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি ইংরেজদের হাত থেকে শাসন ব্যবস্থাকে মুক্ত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। ফলে ইংরেজ কোম্পানির সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। 

আর এই বিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে সংঘটিত হয় বক্সারের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মাধ্যমে মীর কাসিমের শাসনকালেরও পরিসমাপ্তি হয়।

মীর কাসিমের শাসনকাল : ১৭৬০ সালের ২২ অক্টোবর হীর কাসিম বাংলার মসনদে আরোহণ করেন এবং ১৭৯৪ সালে তার শাসনের ইতি ঘটে। নিম্নে মীর কাসিমের শাসনকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

১. কোম্পানির পাওনা পরিশোধ : মসনদে আরোহণ করেই তিনি চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিকে 

(i) বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করেন; 

(ii) কোম্পানির সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য দশ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। 

(ali) তিনি ভ্যাপিটার্ট এবং তার সহযোগীদের পুরস্কার স্বরূপ দুই লক্ষ পাউন্ড এবং কর্ণটিক যুদ্ধের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ লক্ষ টাকা প্রদান করেন; 

(iv) শ্রীহট্টের চুন ব্যবসায়ের জন্য 'পরওয়ানা' প্রদান করেন এবং কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকার প্রদান করেন। এভাবে তিনি কোম্পানির প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে ঋণ মুক্ত হন।

২. অর্থ সংস্কার : মীর কাসিম যখন বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন বাংলার রাজকোষ ছিল প্রায় শূন্য। তদুপরি সিংহাসন লাভের পর ইংরেজ কোম্পানিকে তার পাওনা মেটাতে এবং যেসব ইংরেজ তাকে নবাব হতে সাহায্য করেছিলেন তাদের উপঢৌকন দিতে গিয়ে তার আর্থিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় মীর কাসিম তার রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতি মনোনিবেশ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

(ক) তিনি পূর্ববর্তী নবাবী আমলের সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারীর ও অভিজাত সম্প্রদায়ের বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।

(খ) তিনি মীর জাফর ও আলীবর্দী খানের পরিবারের কাছ থেকে সঞ্চিত অর্থ বলপূর্বক আদায় করেন।

(গ) তিনি জমিদারদের উপর আবওয়াব বা অতিরিক্ত কর ধার্য করেন।

(খ) শেঠ পরিবারের নিকট হতেও তিনি প্রচুর অর্থ বাপ হিসেবে গ্রহণ করেন।

(ঙ) সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও তিনি নতুন কর ধার্য করেন। 

(চ) শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি য ব্যয় সংকোচন করার চেষ্টা করেন।

এভাবে বিভিন্ন উপায়ে অবলম্বন করে মীর কাসিম তার অর্থাভাব দূর করতে সমর্থ হন এবং অর্থব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনয়ন করেন।

৩. শাসন সংস্কার : মীর কাসিম ইংরেজদের হাতে নবাব মীর জাফরের মত ক্রীড়ানক থাকতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ছিলেন মীর জাফর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে গড়া। মীর কাসিম ছিলেন সুদক্ষ শাসক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক। 

ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ইচ্ছা হয়তো তার ছিল না, কিন্তু তাই বলে তিনি নিজেকে শক্তিশালী করে ভুলবার চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। 

মীর কাসিম প্রকৃত নবাব হিসেবেই শাসনকার্য চালাতে কৃতসংকল্প হন এবং শাসনকার্যে সংস্কার আনয়ন করে স্বীয় শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। 

তিনি বার্ষিক ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার করে দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলমের নিকট হতে সমর্থন লাভ করেন। 

তিনি ইংরেজদের মিত্রভাবাপন্ন এরূপ সকল শ্রেণির কর্মচারী ও জমিদারগণকে কঠোর হাতে দমন করেন। এদের মধ্যে বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণের নাম উল্লেখযোগ্য। 

ইংরেজ কোম্পানির প্রভাব থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন এবং নব প্রতিষ্ঠিত রাজধানীকে দুর্গের দ্বারা পরিবেষ্ঠিত করেন। এভাবে মীর কাসিম শাসন সংস্কার করে শাসন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন।

৪. সামরিক সংস্কার : মীর কাসিম উপলব্ধি করেছিলেন শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছাড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভবপর নয়। এজন্য তিনি ক্ষমতায় এসে সামরিক বাহিনীর সংস্কারের প্রতি মনোনিবেশ করেন। 

দেশীয় সৈন্যবাহিনীর অপদার্থতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, নিজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও হয়তো তাঁকে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্যে প্রবৃত্ত হতে হবে। 

তাই তিনি সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হলে নবাব বাহিনীতে যে সংস্কার প্রবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন তা উপলব্ধি করেন। 

তাই তিনি মারকত, সামরু ও জেন্টিল নামে তিনজন ইউরোপীয় সেনাপতির সাহায্যে ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতিতে নিজ বাহিনী সংগঠিত করেন। 

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নুর্ধর্ষ ভাতার, আফগান ও পারসিকগণকে তার সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করেন। কিছুসংখ্যক আর্মেনিয়ানও তার সৈন্যনলযুক্ত হয়। 

মুঙ্গেরে একটি বিরাট অস্ত্র কারখানা স্থাপন করে তথায় বন্দুক, কামান অন্যান্য যুদ্ধোপকরণ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। মুঙ্গেরে প্রস্তুত কামান ও বন্দুক ইউরোপে তৈরি কামান বন্দুক থেকে কোন অংশে নিম্নমানের ছিল না।

৫. মীর কাসিমের রাজস্বনীতি : মীর কাসিম রাজস্ব ক্ষেত্রে কিছু নতুনত্ব আনায়ন করেন। তিনি জমিদারগণকে উৎপীড়ন করে এবং তাদের উপর কয়েকটি নতুন আবওয়াব বা অতিরিক্ত কর ধার্য করে রাজস্ব বৃদ্ধি করাতে সমর্থ হন। 

তার অর্থলোলুপতা থেকে বাংলার জমিদার বা প্রজা কেউই রক্ষা পায়নি। তবে একথা স্মরণ রাখা উচিত যে, মীর কাসিম তার রাজস্বনীতির দ্বারা নিজের অর্থাভাব দূর করে। তিনি ইংরেজ কোম্পানির কর্তত্ব থেকে মুক্ত হতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

৬. বাণিজ্যিক সংস্কার : ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পর কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। এসময় থেকে তারা এমন সব পণ্য করবিনা করতে থাকে বাঁ তারা পূর্বে করেনি। 

এসব পণ্যগুলো ছিল লবণ, পান ও তামাক। এসব পণ্যের উপর বাংলার সরকারের একচেটিয়া অধিকার স্বীকৃত ছিল। এসময়কালে আবার কোম্পানির কর্মচারীরা এবং তাদের আত্মীয়স্বজনেরা দন্তকের অপব্যবহার করে বাণিজ্য করতে থাকে। 

এর ফলে বাংলার অর্থনীতি সুনিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক, বাণিজ্য শুল্ক বাবদ রাষ্ট্রের আয় কমে যায়। মীর কাসিম হিসাব করে দেখেন যে, ইংরেজ কর্মচারীদের অবৈধ বাণিজ্যের ফলে রাষ্ট্রের আয় বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা কমে গেছে। 

দুই, দেশীয় বণিকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। মীর কাসিম এ বিষয়ে ইংরেজ গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। 

কিন্তু তাতেও এ অন্যায় আচরণের কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হল না দেখে তিনি দেশীয় প্রজাদের উপর থেকে শুল্ক উঠিয়ে দিলেন। 

এতে রাজকোষের যথেষ্ট ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু দেশীয় প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মীর কাসিম এ ক্ষতি স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হলেন না।

৭. ইংরেজদের সঙ্গে মীর কাসিমের সংঘর্ষ : মীর কাসিমের কার্যকলাপ ও রীতিনীতিতে বিরক্ত হয়ে পার্টনার ইংরেজ বাণিজ্য কুঠির এজেন্ট এলিস নবাব মীর কাসিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণই একমাত্র পন্থা বলে স্থির করেন। 

এলিস পার্টনা শহর আক্রমণ করলে মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন। নবাব মীর কাসিম পাটনা থেকে ইংরেজগণকে বিতাড়িত করে তা পুনর্দখল করেন। 

এদিকে মেজর এ্যাডামস ১০,০০০ ইউরোপীয় ও ৪০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে মীর কাসিমের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। মীর কাসিমের অধীনে প্রায় ২০,০০০ সৈন্য ছিল বটে, কিন্তু তাদের সামরিক দক্ষতা ছিল না। 

তিনি ক্রমান্বয়ে কাটোয়া, পিরিয়া এবং উদয়নালার যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন। এরপর মেজর এ্যাডামস মুঙ্গেরের দিকে অগ্রসর হলে মীর কাসিম পাটনায় পলায়ন করে সমস্ত ইংরেজ বন্দিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। 

মেজর এ্যাডমস পাটনা অভিমুখে অগ্রসর হলে মীর কাসিম নিরুপায় হয়ে অযোধ্যায় পলায়ন করে নবাব সুজাউদ্দৌলার আশ্রয় গ্রহণ করেন।

৮. বক্সারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ : পূর্বাপর যুদ্ধের ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েও মীর কাসিম হতোদ্যম হননি। তিনি শীঘ্রই অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ইংরেজ বিরোধী মোর্চা গঠন করেন । 

১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বক্সারে মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধ বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। 

এই যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি মনরো সম্মিলিত বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ আলম তৎক্ষণাৎ ইংরেজ পক্ষে যোগ দেন। 

সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে আশ্রয় নেন এবং মীর কাসিম আত্মরক্ষার্থে পলায়ন করেন। ১৭৭৭ সালে পলাতক জীবনযাপনের পর দিল্লির সন্নিকটে মীর কাসিমের মৃত্যু হয়।

উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, বাংলার ইতিহাসে মীর কাসিমের শাসনকাল ছিল তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। তার শাসনামলেই ইংরেজগণ মারাত্মক বিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। 

মীর কাসিম দৈনন্দিন রাজকার্যে ছিলেন নিষ্ঠাবান এবং প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারেও ছিলেন যত্নবান। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, রাজস্ব ও বিচার সংস্কার, অভিজাতদের প্রতি দমনমূলক নীতির প্রয়োগ ও ইউরোপীয় পদ্ধতিতে সৈন্যবাহিনীর পুনর্গঠন প্রভৃতি ব্যাপারে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

সমকালীন যুগের বিলাস বসন পরিত্যাগ করে তিনি শাসনতন্ত্রকে অধিকতর কার্যকর করে শাসন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। 

তবে তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। মোটকথা মীর কাসিম অল্পসময় ধরে রাজত্বকাল করলেও তার শাসনকাল ছিল ইংরেজদের জন্য ত্রাসস্বরূপ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ