প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের পরিচয় দাও । প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের বর্ণনা দাও
প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের পরিচয় দাও । প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের বর্ণনা দাও |
প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের পরিচয় দাও । প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের বর্ণনা দাও
- অথবা, প্রাচীন বাংলার লোকশিল্পের উপর একটি মনোগ্রাহী রচনা লেখ।
উত্তর : ভূমিকা : নিরক্ষর গ্রামের মানুষদের মধ্যে কালে কালে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্য মণ্ডিত লোকশিল্প। বহুদেশের সব অঞ্চলেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই লোকশিল্পের বিভিন্ন শাখার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।
প্রধানত নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটানোর তাগিলে অতি সাধারণ উপকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় লোকশিল্পের বিচিত্র উপাদান।
জীবন-জীবিকার তাগিদ, পেশাগত প্রয়োজনসহ নানা কাজে উদ্ভাসিত হয়েছে লোকশিল্প। বাঙালির লোক শিল্পের রয়েছে একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
তৈরির ধরন, তৈরির উপকরণ, কারুকার্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল হয়ে বাংলার লোকশিল্প স্বাতন্ত্র্য্যমণ্ডিত হয়েছে।
প্রাচীন বাংলার লোকশিল্প : আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাংলার লোকশিল্পের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আদিকাল এর ধারায় এটি এখনো প্রবাহমান।
নিচে বাংলার লোকশিল্পের বর্ণনা করা হলো :
১. মুখশিল্প : লোকশিল্পের সমৃদ্ধ উপাদান তৈরি হয়েছে মাটি নিয়ে। নিরক্ষর দক্ষ কারিগরেরা কাপা, মাটি দিয়ে তৈরি করে বিচিত্র উপকরণ।
মাটির হাঁড়ি, কলসি, পাত্র, বদনা, পুতুল, ছাঁচ, বিভিন্ন জীবজন্ত, ফুল, ফল প্রস্তুতি। প্রতিটি উপকরণই অসাধারণ। শিল্প সৌন্দর্য পূর্ণ হয়ে লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলার মৃৎ শিল্প গড়ে ওঠে অতি প্রাচীন আমল থেকে পাহাড়পুর ও ময়নামতির বিহারে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। এ থেকে বুঝা যায় মৃৎশিল্পের বিস্তার ও উৎকর্ষতা। এ ছাড়া মাটির তৈরি নানা জিনিস পাওয়া গেছে।
২. কাঠের তৈরি লোক শিল্প : বাংলার লোকশিল্পে কাঠের ব্যবহার ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কাঠ তুলনা মূলকভাবে শক্ত ও সহজে খোদহি করা যায়।
এজন্য অতি প্রাচীনকাল থেকে লোক শিল্পে কাঠের ব্যবহার হয়েছে। সেগুলো অলংকরণ করা হয়েছে নানাভাবে।
কাঠের তৈরি উপকরণের মধ্যে ঘরের ছুটি, পরা, জানালা, চৌকাঠ, ঝালক খড়খড়ি, বেড়া, চালের বাত, সিন্দুক, পালকি, চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এসব উপকরণগুলো শুধু প্রাচীনকাল নয় আজও সমান ভাবে ব্যবহার করা হয়। লোক শিল্পীরা কেবল প্রয়োজনের তাগিদে এগুলো তৈরি করেনি, বরং এগুলো সৌন্দর্যও সৃষ্টি করেছে।
৩. বাঁশ, বেতের লোকশিল্প : বাঁশ, বেত ও সোলার তৈরির উপকরণ বাংলার লোক শিল্পের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। কেবল বাঁশি তৈরির কাজেই বাঁশ ব্যবহৃত হয়নি।
বাঙালির নিত্যদিনের নানা প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে বাঁশ। কুড়ের ঘরের পুটি, দরজা, চালা, বেড়া থেকে শুরু করে আসবাব পত্র প্রভৃতি তৈরীতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়।
বাঁশের সাথে আসে বেতের কথা। বেতের শিল্প অতীতকাল থেকেই বহুদেশে ছিল। বিশেষ করে সিলেটের শীতল পার্টি তো জগদ্বিখ্যাত ছিল।
বেত দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা সহজ বিধায় এর ব্যবহার বেশি। বেতের মাদুর ও শীতল পাটি নিত্য ব্যবহার্য উপকরণের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
শীতল পাটি তো বিলাসী উপকরণ। গরমের দিনে শীতল পাটি ব্যবহার হতো অধিক পরিমাণে । এসব পাটি বেশি তৈরি হতো -সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে।
ফরিদপুরের শীতল পাটি এতটাই মূল্যবান ছিল যে মেয়েরা ভালো শীতল পাটি বুনতে পারতো বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব বেড়ে যেত।
৪. পাট ও সুতার লোকশিল্প : বাংলার পাট অতীতকা থেকেই প্রচলিত। এ পার্ট দিয়ে পড়ি কিংবা চট ছাড়া ও তৈরি হতো নানা রকম বস্ত্র। পাট ও তুলার সুতা মিশিয়ে এক রকম বস্ত্র তৈরি হতো।
যা বঙ্গদেশসহ সারা পৃথিবীতে পরিচিত ছিল পাট দিয়ে তৈরি শিকে লোকশিল্পের অমূল্য সম্পদ ছিল। বিভিন্ন জিনিস ঝুলিয়ে রাখার জন্য শিকে তৈরি করা হতো।
শিকে তৈরিতে বাংলার নারীদের দক্ষতা অসাধারণ। শিকে বাংলার নারীরা যেভাবে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতো তা সত্যিই অসাধারণ।
বিশেষ করে পূর্ববাংলার পাটের শিকে সারা ভারত এমনকি ভারতের বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সুতা বা তুলা দিয়ে তৈরি হতো কাপড়।
বাংলার বিভিন্ন কাপড় জগৎ জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল। মধ্যযুগে মসলিন ও মকবল সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল।
এরকম কথা প্রচলিত ছিল যে দশ গজ মসলিন একটি আংটির মধ্যে লুকিয়ে রাখা যেত। ঢাকা থেকে মোগল ও মুর্শিদাবাদের দরবারে মসলিন যেত। ময়মনসিংহও নদীয়ায় মসলিন তৈরি হতো।
৫. হাতির দাঁত ও শঙ্খ তৈরি শিল্প : বাংলায় হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বহুদেশে প্রাচীনকাল থেকেই হাতির দাঁতের তৈরি লোকশিল্পের ব্যবহার হতো।
চন্দ্রকেতু গড়ে হাতির দাঁতের অলংকার পাওয়া গেছে। হাতির দাঁতের শিল্পের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিল মুর্শিদাবাদ জেলা। নবাব এবং তার কর্মচারীরা এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
হাতির দাঁত দুর্লভ ছিল বলে সকল জিনিস তৈরিতে এর ব্যবহার হতো না। প্রধানত ছোট অলংকার কৌটো, চিরুনী ইত্যাদি তৈরি হতো হাতির দাঁত দিয়ে।
বহুদেশে শঙ্গের ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ছিল। বিবাহিতো হিন্দু নারীরা সব সময় শাখের চুড়ি পড়ে। তারা | যে সধবা তার প্রমাণ ছিল শাখের চুড়ি।
চুড়ি ছাড়াও শঙ্খ দিয়ে কৌটো এবং নিত্য প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ তৈরি করা হতো। শঙ্খের তৈরি উপকরণের পায়ে নানাভাবে খোদাই করা থাকত।
৬. ধাতু নির্মিত লোকশিল্প : বাংলার বিভিন্ন ধাতু নির্মিত লোক শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায়। পিতল, লোহা, কাঁসা, তামা, রুপা প্রভৃতি ধাতু দিয়ে তৈরি জিনিসের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
লোহার তৈরি, বটি, পা, কাঁচি, কাসার বাসন কোসন, পিতলের বাসন কোসন প্রচুর পরিমানে ব্যবহার হতো। যশোর ও রংপুরে ভালো পিতলের জিনিস তৈরি হতো।
কাসার জিনিসের জন্য বিখ্যাত ছিল নদীয়া, রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলা। এ ছাড়া ঢাকার সোনা-রুপার কাজ খুব বিখ্যাত ছিল।
এসব ধাতুর তৈরি অলংকার নারী-পুরুষ সকলেই ব্যবহার করতো লোকশিল্প না হলেও প্রাচীন বাংলার লোকেরা রং বেরংয়ের নৌকা তৈরি করতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহার সত্ত্বেও বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো লোক শিল্পের ধারা সজীব রেখেছে। এ লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা আজও বহমান।
আমাদের ব্রত ও অন্যান্য মঙ্গলানুধানের আলপনায়, কাঁচা ও পোড়া মাটির তৈরি পুতুল ও খেলনায়, মনসা ও গাজির পটচিত্রে, মাটির লেপা বেড়ার উপর অথবা সরা ও ঘটের উপর নানা রঙিন চিত্র ও নকশায়, কাঁথার উপর বিচিত্র সূচিকার্যে সেই প্রাচীন লোকায়ত শিল্পের ধারায় প্রবাহমান