পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও । আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন।
পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও |
পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও
- অথবা, ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ-উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণের অল্প দিনের মধ্যেই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে তার বিরোধের সৃষ্টি হয়।
এই বিরোধের পরিণতিই হচ্ছে ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ। এ যুদ্ধ একটি যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনা। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ শাসনের পথ সুগম হয় এবং বাংলা দীর্ঘকালের জন্য স্বাধীনতা হারায়।
পলাশির যুদ্ধ পরবর্তীকালে শাসকরা হারায় স্বাধীনতা আর জনগণ হারায় তাদের আর্থসামাজিক পূর্ব অবস্থা। বাংলার মানুষ আর্থিক দুর্দশায় পতিত হয়।
সামাজিক ক্ষেত্রে বাঙালি ঐতিহ্যের পরবর্তী পাশ্চাত্য ব্যবস্থার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। মোটকথা পলাশির যুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ছিল খুবই করুণ ও দুর্দশাগ্রস্ত ।
→ পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা : ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত হয় ইংরেজ কোম্পানির হাতে। শুধু শাসনক্ষমতাই নয় অর্থনৈতিক ক্ষমতাও চলে যায় কোম্পানির অধীনে।
ফলে বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থায় চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। নিম্নে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বিবরণ দেওয়া হলো।
১. রাজকোষ শূন্যতা : পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার সিংহাসন লাভ করার পুরস্কারস্বরূপ মীর জাফর কোম্পানিকে তার প্রাপ্য অর্থ ক্লাইভকে ২,৩৪,০০০ পাউন্ড এবং কলকাতা কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্যকে ৫০,০০০ পাউন্ড থেকে ৮০,০০০ পাউন্ড উপঢৌকন প্রদান করেন।
কোম্পানি নতুন নবাবের কাছ থেকে ২৪ পরগণার জমিদারি স্বত্ব লাভ করে। এই জমিদারি থেকে কোম্পানি বছরে দেড় লক্ষ পাউন্ড আয় করত। এসবের ফলে কোম্পানি প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়। কিন্তু নবাবের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়।
২. ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ আধিপত্য : পলাশির যুদ্ধের অর্থনৈতিক ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধের ফলে কোম্পানির উপর দেশীয় সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তার অবসান ঘটে।
ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দত্তকের অপব্যবহার করে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়।
এর ফলে নবাবের যেমন আর্থিক ক্ষতি হয়, তেমনি দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ও বণিকদের সমাধি রচিত হয়। মোটকথা, যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে ইংরেজ কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়।
৩. কোম্পানির দেওয়ানি লাভ : পলাশির যুদ্ধের সূচনাকে কাজে লাগিয়ে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমকে পরাজিত করে ইংরেজ কোম্পানি সত্যিকার অর্থে বাংলার উপর একাধিপত্য আরোপ করে।
আধিপত্য আরো শক্তিশালী হ ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানি লাভের মধ্যদিয়ে। ১৭৬৫ সালের ১২ অক্টোবর ক্লাইভ ও সম্রাট শাহ আলমের মধ্যে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এ চুক্তিতে বলা হয়, দেওয়ানি লাভের বিনিময়ে কোম্পানি সম্রাট শাহ আলমকে অযোধ্যায় নিকট থেকে প্রাপ্ত 'কারা' ও 'এলাহাবাদ জেলাঘর এবং পূর্ব বাংলার রাজস্ব আয় হতে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা প্রদান করবে।
এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পূর্ব বাংলার দেওয়ানি হস্তগত করার মাধ্যমে বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করে। আর বাংলার হারায় তার আর্থিক শক্তি।
৪. পোশাক-পরিচ্ছদে পাশ্চাত্য প্রভাব : পলাশির পর বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থায় দারুণভাবে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এসময় পোশাক-পরিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বিদেশি চাপ ফুটে উঠে।
ইংরেজ পোশাক-আশাক বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ধৃতি-পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, শাড়ী প্রভৃতির হলে ক্রমে ক্রমে প্যান্ট, শার্ট, কোর্ট, টাই, সালোয়ার প্রভৃতি পোশাক পরিচ্ছদ বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে।
তাছাড়া দেশীয় বস্ত্রের তুলনায় বিদেশি বস্ত্র সুলভ হওয়ায় বাংলার মানুষ এসব বস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় মারাত্মকভাবে। এভাবে পোশাক-পরিচ্ছেন ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকরণ হয় পলাশির যুদ্ধের পর।
৫. দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ প্রভাব : পলাশির পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইংরেজ কোম্পানির প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুল্ক ছাড়া বাণিজ্য করার সুযোগে কোম্পানি একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে।
আর নিজ দেশে বাণিজ্য করতে হলেও শুল্ক প্রদান করতে থাকে দেশীয় বণিকরা। ফলে বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে দেশীয় বণিকরা।
তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদেশি পণ্যের সয়লাভ লক্ষ করা যায় পলাশির যুদ্ধের পর। এসময় থেকে এদেশে নীলচাষ করার ব্যাপারে কোম্পানি থেকে চাপ আসতে থাকে। শুরু হয় নীল নির্যাতন। ফলে কৃষকদের দুর্দশাও বৃদ্ধি পায়।
৬. দ্বৈত শাসন প্রবর্তন : বাংলার আর্থসামাজিক ব্য সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এসময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসন নামক এক অদ্ভুত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলার শাসন ক্ষমতা নবাব ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে ভাগ করা হয়। এ ব্যবস্থায় বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, ফৌজদারি বিচার, শান্তি রক্ষা, দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলার নবাব, পক্ষান্তরে রাজস্ব আদায় ও লাভের অধিকার এবং নেওয়ানি সংক্রান্ত বিচার কোম্পানির হাতে বার্তায়।
এছাড়া সামরিক শক্তির অধিকারী কোম্পানির হাতে থাকে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব শাসন ক্ষমতার এই বিভাজনকে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বলা হয়।
ক্ষমতার এরূপ বিভাজন থেকে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে, রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা না থাকায় নবাব লাভ করেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব, পক্ষান্তরে রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির হাতে থাকায় কোম্পানি পায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা।
৭. কৃষক নির্যাতন বৃদ্ধি : পলাশির পর প্রবর্তিত দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এব্যবস্থা বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মারাত্মক কুপ্রভাব ফেলে।
কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের লুন্ঠন নীতির ফলে দেশের দুরাবস্থা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে এবং কমমূল্যে দ্রব্যাদি ক্রয় করে অধিক মূল্যে বিক্রি করতে থাকে।
একদিকে কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের লুণ্ঠন ও রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে, ১৭৬৮ হতে পরপর দুই বছর মারাত্মক খরার ফসলহানি ঘটায় প্রচণ্ড খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং খাদ্যশস্যের মূল্য অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়। ফলে বাংলার কৃষকদের দুর্নশা আরো ত্বরান্বিত হয়।
৮. সামাজিক অবক্ষয় : পলাশির পর থেকে বাংলার সামাজিক জীবনে মারাত্মক অবক্ষয় দেখা দেয়। জমিদারদের নির্যাতন, ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ প্রভাব প্রভৃতির কারণে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম সংকটে পতিত হয় ফলে মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে অবক্ষয় ভাব সৃষ্টি হয়।
ছিনতাই, রাহাজানি, দস্যুবৃত্তি, ডাকাতি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কোম্পানির কর্মচারী এবং তাদের অনুগ্রাহপুষ্টিরা স্বহস্তে আইন তুলে নেয়।
এসময় থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, চারিত্রিক অধঃপতন প্রভৃতি মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে।
৯. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার : বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক যে দিকটি ফুটে উঠে তা হলো পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার। পলাশির পর থেকে শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হস্তগত হয়।
কোম্পানি শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে এদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে থাকে। ফলে এদেশে গড়ে ওঠে স্কুল, কলেজ, মিশনারী স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যদিও কোম্পানি নিজেদের প্রয়োজনে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। তথাপি বাংলার জনগণও পরোক্ষভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উপকৃত হতে থাকে। এভাবে বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে।
১০. স্বাস্থ্য সেবার প্রসার : পলাশির যুদ্ধের পূর্বে বাংলার জনগণের জীবনে দুরারোগ্য ব্যধি ডায়েরিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পলাশির যুদ্ধের পর কোম্পানি এদেশে নতুন নতুন হাসপাতাল, চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে থাকে।
ফলে এসব স্বাস্থ্য সেবা বাংলার মানুষও পরোক্ষভাবে লাভ করতে থাকে। ফলে বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে মৃত্যুহার হ্রাস পেতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয় বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক নীতিতে কোম্পানির আধিপত্যবাদের সূচনা হয়।
এসব ক্ষেত্রে কোম্পানির একচেটিয়া . অধিকার লাভ করে। সামাজিক ক্ষেত্রেও এসময় পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ করা যায়, পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, পোশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতি বাংলার সামাজিক জীবনে নতুনত্ব অনিয়ম করে।
মোটকথা পলাশির পর বাংলার আর্থসামাজিক জীবন মধ্যযুগীয় অবস্থা থেকে আধুনিক জীবনে প্রবেশ করে। তাই বাংলার আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পলাশির যুদ্ধের প্রভাব ছিল স্পষ্ট।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও । যদি তোমাদের আজকের পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো।