নবাব সিরাজ উদ দৌলার শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
নবাব সিরাজ উদ দৌলার শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যাসমূহ আলোচনা কর |
নবাব সিরাজ উদ দৌলার শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, নবাব সিরাজের সিংহাসনে আরোহণকালীন প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্বল্প সময়ের রাজত্বকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাতামহ আলীবর্দী খান বিহারের সহকারী শাসনকর্তার পদ লাভের ঠিক আগে ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজের জন্ম হয়।
নবাব আলীবর্দী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না, সুতরাং মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার কনিষ্ঠ কন্যার পুত্র সিরাজ-উদ-দৌলাকে বাংলার পরবর্তী নবাব মনোনীত করে যান।
তার দৌহিত্রদের মধ্যে সিরাজ-উদ-দৌলাই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। ফলে ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে তার দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার মসনদে আরোহণ করেন।
মাত্র তেইশ বছর বয়সে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করলেও তার এই সিংহাসন অধিকার অন্যান্য উত্তরাধিকারী ও অমাত্যবর্গ ভালোভাবে মেনে নেয়নি।
ফলশ্রুতিতে তারা নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে এবং সিংহাসনে আরোহণকে কন্টকাপূর্ণ করে তোলে ।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যা : মাতামহ আলীবর্দী খানের অত্যধিক স্নেহে লাগিত নবাব সিরাজ খুব সহজে মসনদ অধিকার করেন ঠিকই কিন্তু মসনদ রক্ষা- করার জন্য তাকে বেশকিছু প্রাথমিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়।
নিম্নে নবাব সিরাজের শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. উত্তরাধিকার সমস্যা : নবাব আলীবর্দী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাই নবাব তার তিন কন্যার সঙ্গে তার বড় ভাই হাজি আহমদের তিন পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন।
এটি ছিল ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রিভূত করার এক সনাতন কৌশল। নবাব আলীবর্দীর তিন জামাতাকে তিনটি অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করেন।
একজনকে ঢাকার, অন্যজনকে পূর্ণিয়ার এবং সিরাজের | পিতা জৈনুদ্দিনকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। এই নিকট আত্মীয়ের অনেকেই অপুত্রক আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর মসনদ লাভের আশা পোষণ করতেন।
সুতরাং আলীবর্দী খান সিরাজকে পরবর্তী নবাব মনোনীত করলে তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব থেকেই নবাব সিরাজকে উত্তরাধিকার সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
২. শওকত অঙ্গের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : নবাব আলীবর্দী খান তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলার জন্য মসনদের সাথে অনেক সমস্যাও রেখে যান। তার নিজের পরিবারেই ছিল অনৈক্য।
তাদের মধ্যে ছিল সিরাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। সিরাজ মসনদে আরোহণ করেই এসব সমস্যার সম্মুখীন হন এবং দেখতে পান চারদিকে চক্রান্তকারীদের জাল পাতা রয়েছে।
সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যেও সিরাজের শত্রুর অভাব ছিল না। তার প্রধান শত্রু ছিল তারই খালাতো ভাই পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ।
সিরাজ মসনদে আরোহণের পর শওকত জন তাকে অভিনন্দন বাণী পাঠাননি। এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে শওকত জঙ্গ সিরাজের অনুগত ছিলেন না।
তিনি ঔদ্ধত্য শওকত জঙ্গকে দমন করার উদ্দেশ্যে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে মুর্শিদাবাদ থেকে | সসৈন্যে পূর্ণিয়ার উদ্দেশ্যে গমন করেন।
কিন্তু সে যাত্রায় শওকত জঙ্গ রক্ষা পান। পরবর্তীতে ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় পূর্ণিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন শওকত জঙ্গকে দমনের জন্য।
১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর নবাবগঞ্জের মনিহারি গ্রামে [দু'পক্ষে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শওকত জঙ্গ পরাজিত ও নিহত হয়। ফলে নবাব প্রধান শত্রু হতে মুক্ত হন।
৩. ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত : সিরাজ-উদ-দৌলার অপর প্রধান শত্রু ছিলেন তার বড়খালা আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ঢাকার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার বিধবা পত্নী ঘষেটি বেগম।
ঘষেটি বেগম ছিলেন অপুত্রক। সিরাজের ছোট ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে তিনি লালন-পালন করেন। তার ইচ্ছা ছিল নবাব আলীবর্ণীর মৃত্যুর পর ইকরামউদ্দৌলাকে মসনদে বসাবেন।
কিন্তু আলীবাসীর মৃত্যুর পূর্বেই ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তরোগে ইকরামউদ্দৗলার মৃত্যু হয়। নিঃসন্তান কন্যা ঘষেটি বেগমকে আলীবর্দী অত্যধিক স্নেহ করতেন।
এই সুবাসে পিতার উপর প্রভাব বিস্তার করে ঘষেটি বেগম প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হন এবং মুর্শিদাবাদের কয়েক মাইল উত্তরে পরিবেষ্টিত মতিঝিল প্রাসাদে তার ধন-সম্পদ গচ্ছিত রাখেন।
ঘষেটি বেগম নিঃসন্তান হয়েও রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন এবং সিরাজের অন্য কোনো প্রতিবন্ধী না পেয়ে শওকত অঙ্গের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন।
তিনি শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানান। এছাড়া সিরাজের শত্রু যে যেখানে ছিল সকলেই ঘষেটি বেগমের আশীর্বাদ লাভ করে।
এমতাবস্থায় সিরাজ ঘষেটি বেগমের দিকে মনোনিবেশ করেন। ঘষেটি বেগমের অর্থ- সম্পদের প্রতি সিরাজের লোভও ছিল। তিনি ঘষেটি বেগমের মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করার জন্য একদল সৈন্য পাঠান।
বেগমও বাধা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু লোকজন জড়ো করেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তার অনুচরবৃন্দ সকলেই তাকে ত্যাগ করেছে, কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
সিরাজ কোনো প্রকার রক্তপাত ছাড়াই ঘষেটি বেগমের প্রাসান অধিকার করে তার অর্থসম্পন নিজের হস্তগত করেন।
৪. মীর আফরের ষড়যন্ত্র : নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার তৃতীয় ও সর্বপ্রধান শত্রু ছিলেন মীর জাফর আলী খান। তিনি নবাবের প্রধান সিপাহসালার বা সেনাপতি ছিলেন। মীর জাফর আলী খানও আলীবর্দী খানের মত কপর্দকহীন অবস্থায় ভারতে আসেন।
আলিবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহখানমকে বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান। মীর জাফর আলী প্রথমে পুরাতন সৈন্যবাহিনীর বকশী পদে নিযুক্ত হন এবং পরে প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন।
তিনি সাহসী যোদ্ধা হিসেবে অনেক যুদ্ধে বীরত্বও দেখিয়েছেন। কিন্তু মীর জাফর ছিলেন অকৃতজ্ঞ। প্রভু আলীবর্দীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
তার যুক্তি ছিল, আলীবর্দী খান যদি তার প্রভু ও পৃষ্ঠপোষক সুজাউদ্দীনের পুত্র সরফরাজকে হত্যা করে মসনদ অধিকার করতে পারেন, তবে তারও তার প্রভুর উত্তরাধিকারীকে হত্যা করে মসনদে বসার অধিকার আছে।
প্রকৃতপক্ষে প্রাসাদের ভেতরে ও বাইরে তখন এমন অকৃতজ্ঞ, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক এবং উচ্চভিলাষী লোকের সংখ্যা ছিল প্রচুর।
অবশ্য মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্রই তখন নৈতিকতাবর্জিত অবস্থা বিরাজ করছিল। সিরাজের সময় মীর জাফর আফিম ও ডাউ খেয়ে এবং ইন্দ্রিয়ের ভোগ বিলাসে মগ্ন থেকে তার পূর্ব গৌরব তথা উদ্যম ও কর্মশক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলে কাপুরুষে পরিণত হন।
কিন্তু প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার হাতে প্রচুর ক্ষমতা থাকায় শাসন কার্যে তার প্রচুর প্রভাবও ছিল। সুতরাং মীর জাফর তরুণ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার একজন প্রবল শত্রু হয়ে ওঠেন।
নবাব সিরাজ-উল- দৌল এমতবস্থায় মীরজাফরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে মীর মদন নামক এক বিশ্বস্ত যোদ্ধাকে ঐ পদে নিয়োগ করেন। অবশ্য সিরাজ মীর জাফরকে পুনরায় প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ করেন।
৫. কৃষ্ণদাসের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ : আলীবর্দীর মৃত্যুর আগেই রাজডের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়। রাজা রাজবল্লভ তখন মুর্শিদাবাদে ছিলেন।
তাকে বন্দি করা হয় এবং হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু আলীবর্দী খান মৃত্যুশয্যা থেকে তাকে রক্ষা করেন। সিরাজ তার অনুচরদের ঢাকায় পাঠান এবং নির্দেশ দেন রাজবল্লভের ধন সম্পন্ন যেন বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার পরিবার পরিজনদের আটক করা হয়।
রাজবল্লুতের গোপন নির্দেশে তার পুত্র কৃষ্ণদাস তখন পরিবার পরিজন ও আনুমানিক ৫৩ লক্ষ টাকার ধন সম্পদসহ কলকাতায় ইংরেজদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করে।
নবাব কৃষ্ণদাসের সমর্পণ দাবি করলে ইংরেজগণ তা অমান্য করে। নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবের একজন অপরাধী প্রজাকে কলকাতায় আশ্রয় দানের একটি প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। যা ছিল নবাবের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
৬. ইংরেজদের সহযোগিতা : সর্বোপরি ইংরেজদের অসহযোগিতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সিরাজের শাসনকার্যের জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
আলীবর্দী খানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র বাংলার ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতির সূত্র ধরে বাংলায় অবস্থিত তাদের ঘাঁটিগুলোতে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে।
আলীবর্দী খানের মৃত্যুতে নবাবের মসনদে আরোহণের আনুষঙ্গিক ব্যস্ততার সুযোগ গ্রহণ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতি ইংরেজগণ প্রথম থেকেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও অবহেলা প্রদর্শন শুরু করে। আলীবর্দীর মৃত্যুর কিছুকাল পরে সিরাজ সংবাদ পান যে, ইংরেজগণ আলীবর্দীর মৃত্যুর পর ঘষেটি বেগমকে সিরাজের বিরুদ্ধে সাহায্য দানে প্রতিশ্রুত হয়েছে।
তাছাড়া সিরাজ যখন মসনদে আরোহণ করেন তখন ইংরেজগণ নতুন নবাব হিসেবে তাকে উপঢৌকন প্রেরণের চিরাচরিত রীতি অমান্য করে।
উপরন্তু ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজগণ ও ফরাসি | বণিকগণ বাংলায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে।
সিরাজ-উদ-দৌলা তাদেরকে নিরস্ত হতে আদেশ দেন। ফরাসি বণিকগণ সিরাজের আদেশ অনুযায়ী দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করে, কিন্তু ঔদ্ধত্যপূর্ণ ইংরেজগণ সিরাজের আদেশ উপেক্ষা করে দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখে।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, আলীবর্দী খান মৃত্যুর সময় সিরাজের জন্য শুধুমাত্র বাংলার মসনদই রেখে যাননি, রেখে যান অনেক সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা।
যার ফল ভোগ করতে হয় তরুণ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে। সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব থেকেই এসব সমস্যা, দানা বাঁধতে থাকে এবং সিংহাসনে আরোহণের পরও সমস্যাগুলোর অস্তিত্ব টিকে থাকে।
নবাব একে একে এসব সমস্যার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং ঘষেটি বেগম, শওকত জঙ্গ, কৃষ্ণদাস, মীর জাফর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার মোকাবিলা করেন।
তিনি ইংরেজগণ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যারও সমাধান করতে সক্ষম হন তার রাজত্বের প্রথম ভাগে। মোটকথা, সিরাজের শাসনকালের প্রাথমিক সমস্যা ছিল অনেক যা তিনি মোকাবিলা করতে সমর্থ হলেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি, যার পরিণাম তার পতন ।