মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল। আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন।
মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল |
মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল
- অথবা, মুঘল আমলে সাংস্কৃতিক অবস্থার বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতি শুরু হয়। মুঘল আমলে সাংস্কৃতিক অবস্থার মানদণ্ড হিসেবে স্থাপত্য ও চিত্রকলার ব্যাপক বিকাশের পাশাপাশি মুঘল সঙ্গীত-নৃত্য প্রভৃতির ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়।
এ সময় মুঘল শাসকগণ সংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দান করলে সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে পদচারণা ঘটে।
মুঘল আমলে শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অবস্থা : নিয়ে মুঘল আমলের শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(ক) চিত্রকলা : মুঘল চিত্রকলার উদ্ভব হয় সম্রাট আকবরের সময়ে। তবে সম্রাট হুমায়ূন যখন শেরশাহের সাথে পরাজিত হয়ে পারস্যে আশ্রয়লাভ করেন তখন তিনি চিত্রকলার প্রতি আকর্ষিত হন।
তিনি পারস্যের দুজন বিখ্যাত চিত্রকর মীর 'সৈয়দ আলী ও খাজা আবদুস সামাদকে ভারতে নিয়ে আসেন এবং তাদের তত্ত্বাবধানে আঁকা 'দস্তান-ই-আমীর হামজা' চিত্রের মাধ্যমে মুঘল চিত্রকলার সূচনা হয়।
সম্রাট আকবরের সময়ে ১০০ জন চিত্রকরের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আবদুস সামাদ, খসরুকুলি, জামসেদ, দশবন্ত, বাসাওয়ান, সানওয়াল দাস, তারাচাঁদ প্রমুখ অন্যতম।
তবে মুঘল শাসকদের মধ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে মুঘল চিত্রকলার সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটে। তার সময় মুঘল চিত্রকলার স্বর্ণযুগ তৈরি হয়।
তার সময়ের বিখ্যাত চিত্রকরদের মধ্যে মনোহর, আবুল হাসান ও ওস্তাদ মনসুর অন্যতম। শাহজাহানের সময়ে মুঘল চিত্রকলা তেমন বিকাশ লাভ করেনি।
(খ) মুঘল যুগের সাহিত্য : নিম্নে মুঘল যুগের সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. শিখ ভক্তি সাহিত্য : মুঘল যুগে সুফিবাদের ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। আর এ সকল সুফিরা ইরাক, তুর্কি, আফগান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ভারতে আগমন করে।
আর তাঁদের সবাই উত্তরা ভারত হয়ে প্রথমে ভারতে পরে সেখান থেকে পুরো ভারতবর্ষ তথা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সকল সুফিসাধক সুফিবাদের প্রচারে বিশেষ ভক্তিমূলক সাহিত্য ও গান রচনা করে।
মুঘল আমলে পাঞ্জাবে গুরুভিত্তিক বিশেষ করে হিন্দু গুরুভিত্তিক ভক্তি গান এবং একেশ্বরবাদের ভক্তিদানের মিশ্রণে পাঞ্জাবে ভক্তিমূলক সাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
২. হিন্দি ভক্তিসাহিত্য : মুঘল আমলে হিন্দিভাষায় বহুবিখ্যাত ভক্তি সাহিত্য, ভাবসাহিত্য, প্রেমমূলক রচনার প্রভূত উন্নতি ঘটে। সুলতানি আমলে হিন্দি সাহিত্যের প্রসার ঘটলেও মুঘল আমলে হিন্দি সাহিত্যের প্রসারের ব্যাপ্তি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল।
মূলত ব্রহ্মকে অবলম্বন করেই ভাব, প্রেম, ভালোবাসার কাব্য রচিত হয়। মালিক মুহাম্মদ জায়সীর পাদুমাধক, কুকুবানের মৃগবর্তী এবং মন জাহানের মধুমালতি ছিল এসব সাহিত্যের মধ্যে প্রধান।
৩. ব্রজবুলি সাহিত্য : মুঘল আমলে ভারতবর্ষে হিন্দি সাহিত্যের পাশাপাশি ব্রজবুলি সাহিত্যেরও ব্যাপক বিকাশ ঘটে। ব্রজবুলি ছিল একটা কৃত্রিম ভাষা। যা শুধুমাত্র সাহিত্য রচনায় ব্যবহার হতো।
মিথিলার কবি বিদ্যাপত্তি ব্রজবুলি ভাষায় সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মূলত শ্রীকৃষ্ণের জীবন কাহিনি অবলম্বনে প্রেমমূলক সাহিত্য রচনা করেন। এছাড়া আরও কয়েকজন কবি ব্রজবুলি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন।
৪. উর্দু সাহিত্য : মুঘল শাসকগণ যেহেতু সবাই মুসলিম ছিলেন। আর ভারা ডুরস্ক থেকে আগমন করেন। তাই স্বভাবতই মুসলিম হওয়ার উর্দু ভাষার প্রতি একটা দুর্বলতা তাদের ছিল।
তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল আমলে উর্দু সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। মূলত ভারতে চতুর্দশ শতক থেকে উর্দু একটা স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
খাড়ীবোলী বা জবান-ই-ডিলারী থেকে উর্দুর উদ্ভব হয়েছে। এ সময় বেশ কিছু নামি লেখকের মাধ্যমে উর্দু সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
৫. গুড়িয়া সাহিত্য : ভারতের সকল স্থানের মতো এবং সকল ভাষার ন্যায় উড়িয়া ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়। মুঘল আমলে অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ন্যায় উড়িয়া ভাষার সাহিত্যও বেশ খ্যাতি অর্জন করে।
উড়িয়া সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা কবি ছিলেন। উপেন্দ্র ভক্ত। তিনি মুঘল রাজসভা কবি ও ভাষার জাদুকর ছিলেন। তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন উড়িয়া ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন।
৬. বাংলা ভাষায় সাহিত্য : মধ্যযুগে বিশেষ করে মুঘল আমলে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় আসে এক অন্যধারা। যা বাংলা ভাষায় সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।
বাঙালি কবি, লেখকরা প্রদেশ, মাটি, প্রকৃতি, মানুষের জীবনধারা নিয়ে অসংখ্য কবিতা, গান, সাহিত্য রচনা করেন এবং তারা বাংলা সাহিত্যকে বিকশিত করেছেন। মুরারী গুপ্ত, নরহরি সরকার, বাসুদেব ঘোষ, রামানন্দ, লোচনদাস প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন।
৭. অহমিয়া ও গুজরাটি সাহিত্য : মুঘল আমলে আঞ্চলিক সাহিত্যের মধ্যে অহমিয়া সাহিত্য অন্যতম উচ্চতার আসীন হয়। এসময় শংকর দেব, মাধব দেব এবং বৈষ্ণব ভক্তি গ্রন্থ কীর্তনঘোষ রচিত হয়।
আবার গুজরাটি সাহিত্য বিজয় সেনের রেবস্তু, গিরিদাস, শ্রীধরের রচনা রণমরচন্দ্র উল্লেখ্য। গুজরাটি আঞ্চলিক ভক্তিগীতি তখন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
৮. মারাঠি সাহিত্য : মারাঠি সাহিত্য বিশেষ করে মারাঠ | সাধন-ভান ও আঞ্চলিক ফোকসাহিত্য তখন বিকাশ লাভ করে। ভুকারামের আতল, ফাদার স্টিফেনসের রচনা কৃষ্ণপুরাণ, রামদাস ও বামন পণ্ডিতের রচনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৯. ফারসি সাহিত্য : মূলত আজকে যে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, এতে আছে বহু ফারসি ভাষার শব্দ। ধারণা করা হয় ফারসি ভাষা তৎকালীন ভারতে তার সঙ্গীত ও সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে এতটাই বিস্তার লাভ করে যা ফারসি, সাহিত্যকে ভারতবর্ষে অন্যতম উচ্চতার প্রতিষ্ঠা করে। মুঘল আমলে ফারসি ভাষায় বিশেষ বিকাশ ঘটে। ঐ সময় ফারসি ভাষায় বহু রচনা পাওয়া যায়।
১০. ঐতিহাসিক রচনা : মুঘল সম্রাট বাবর হতে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত আমরা বহু মুঘল শাসকের জীবনী গ্রন্থের সন্ধান পাই। আর এ সকল জীবনী গ্রন্থ রচনায় লেখকগণ তাদের ঐ সময়ের যুদ্ধ বিগ্রহ ও অন্যান্য বিষয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা ভারতে সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
(গ) শিক্ষা : নিয়ে মুঘল যুগের শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা : কোম্পানি আমলের পূর্বে অর্থাৎ ভারতে কোম্পানির প্রবর্তিত পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পূর্বে মূলত ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় উৎকর্ষ সাধন এবং ধর্মীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্যই মূলত তখন মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতো।
২. মক্তব বা গ্রাম্য : পাঠশালাভিত্তিক উইলিয়াম এডাম ১৮৩৫, ১৮৩৬, ১৮৩৭ দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, এখানে মূলত দ্বি-স্তর বিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
১. মজব ও মাদ্রাসা এবং
২. পাঠশালা ও টোল।
টোলে সাধারণত সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা আর মাদ্রাসার আরবি, ফারসি ও উর্দু শিক্ষা নেওয়া হতো।
৩. হিন্দু শিক্ষাব্যবস্থা : ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে মূলত হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। হিন্দুরা মূলত সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানচর্চা করতো। আর শিক্ষা কেন্দ্র ছিল গ্রাম্য পাঠশালা ও উচ্চ শিক্ষায় টোল।
৪. মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা : মুসলিমরা সাধারণত মক্তব শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য মাদ্রাসায় যেত। এখানে তারা আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতো। তবে এ সময় শিক্ষা শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
৫. উচ্চশিক্ষার বিষয় : ভারতে বিজ্ঞান চর্চার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য সাধারণত পাঠ্য বিষয় ছিল আরবি ও ফারসি সাহিত্য, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি।
৬. উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র : তখন ভারতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এতো সহজলভ্য ছিল না। হিন্দুদের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নদীয়া বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
বিদেশিদের কাছে নদীয়া ছিল অক্সফোর্ডতুল্য। তাছাড়া নদীয়ার শিক্ষকদের পাণ্ডিত্য ও চারিত্রিক উৎকর্ষতার ভূয়সী প্রশংসা তারা করেছেন।
(ঘ) মুঘল যুগে সঙ্গীত : ইসলামে সঙ্গীত সাধনার বিরোধিতা করলেও মুঘল শাসকরা সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন। সম্রাট আকবর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পছন্দ করতেন এবং তিনি নিজে কয়েকটি সুর তৈরি করেন।
মুঘল যুগে মিয়া তানসেন সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। পিতার মতো সম্রাট জাহাঙ্গীর সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তার সময়ে মোহাম্মদ শালীহ খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন । সম্রাট শাহজাহান নিজেই একজন সুর সাধক ছিলেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল শাসনামলে ভারতের সাংস্কৃতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এ সময় সংস্কৃতির স্থাপত্য, শিক্ষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মুঘল চিত্রকলা স্বর্ণময় যুগে প্রবেশ করে এবং শাহজাহানের সময়ে স্থাপত্য শিল্পের স্বর্ণযুগ সৃষ্টি হয়।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল। যদি তোমাদের আজকের মুঘল যুগে সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো।