মিশরের মামলুক বাইবার্সের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
মিশরের মামলুক বাইবার্সের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর |
মিশরের মামলুক বাইবার্সের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
- অথবা, মিশরে মামলুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রথম বাইবার্সের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
- অথবা, মিশরে মামলুক বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রথম বাইবার্সের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মিশরে মামলুক বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ তাঁরা ক্রীতদাস শ্রেণি থেকে মিশরের আইয়ূবী বংশের পতন ঘটিয়ে মামলুক শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
আর মামলুক বংশের বিভিন্ন শাসকদের মধ্যে প্রথম বাইবার্সের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের বিদ্রোহ দমন, শিয়া ষড়যন্ত্র, বার্বারদের অপতৎপরতা, গুপ্তঘাতকদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি প্রতিহত করে মামলুক সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মামলুক বংশের শাসক হিসেবে তিনি যে কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা করে তার জন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
প্রাথমিক জীবন : সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ১২২৩ সালে কিপচাক তুর্কি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যকাল অত্যন্ত দুঃখ বেদনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল।
তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল দামেস্ক ও সিরিয়ায় ক্রীতদাস হিসেবে। ১২৪৬ সালে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ তাকে এক ব্যবসায়ীর নিকট থেকে উচ্চ মূল্যে ক্রয় করে নিজ দেহরক্ষী বাহিনীতে নিযুক্ত করেন।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বাইবার্স নিজ মেধা, সাহস, অধ্যবসায় ও দুঃসাহসিকতা দ্বারা সুলতান আল সালিহের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন এবং সুলতান তাকে দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।
এ সময় ১২৪৭ সালে ফ্রান্সের রাজা নবম লুই দামিয়েত্তা দখল করে নেন। কিন্তু বাইবার্সের দৃঢ়তায় মানসুরার যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হলে আইয়ুবীয় সুলতান আস সালিহ খুশি হয়ে বাইবার্সকে আলেপ্পোর শাসক নিযুক্ত করেন।
সিংহাসনারোহণ : সুলতান সাইফুদ্দিন কুভুজের সময় রুকনউদ্দিন বাইবার্স সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। এ সময় মোঙ্গল সেনাপত্তি কেতরুমা খান লিবিয়া দখল করে মিশরের দিকে অভিযান চালান।
ফলে ১২৬০ সালে ঐতিহাসিক আইন-ই-জালুতের প্রান্তরে মামলুক মোঙ্গলদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে বাইবার্সের অসীম সাহসিকতা, দূরদর্শিতা, রণনিপুণতার জন্য মামলুকগণ বিজয়ী হন। বিজয়ী সেনাপ্রধান বাইবার্স অযোগ্য মামলুক সুলতান কুতুজাকে হত্যা করে সিংহাসনারোহণ করেন।
→ বাইবার্সের কৃতিত্ব : নিম্নে মামলুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান এবং প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাইবার্সের কৃতিত্ব বর্ণনা করা হলো :
১. আব্বাসীয় খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা : ১২৬০ সালে বাইবার্স সিংহাসনে আরোহণ করে ১৯৫৮ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত আব্বাসীয় খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
এর পেছনে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল আব্বাসীয় খলিফার স্বীকৃতিলাভের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে নিজের শাসনকালের স্বীকৃতিলাভ ।
২. অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান : বাইবার্স সুলতান কুতুজকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করায় সিরিয়ায় সিনজারের নেতৃত্বে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয়।
তাছাড়া কারাক ও গাজার শাসনকর্তা মুখিত ও শামসুদ্দিন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাইবার্স অত্যন্ত সুকৌশলে এই নেতাদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
৩. ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান : সুলতান বাইবার্সের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের সুযোগে ক্রুসেডারগণ কারাক, সাইকাত ও এন্টিকে শহরগুলো একে একে দখল করে নেন।
ফলে এবার বাইবার্স তার দৃষ্টি ক্রুসেডারদের উপর দেন এবং ১২৬১-৭২ সালের মধ্যে অভিযান চালিয়ে হাতরাজাগুলো পুনরুদ্ধার করেন।
৪. মোঙ্গলদের সাথে সংঘর্ষ : ইতোপূর্বে মোঙ্গলগণ হিমস ও আইন-ই-জালুতের যুদ্ধে পরাজিত হলেও তারা মামলুক বিরোধী নীতি ত্যাগ করেননি। ফলে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান ১২৬৫- সালে হিমস ও সাইকা দখল করে বিধায় উপস্থিত হন।
এখানে ১২৭৩ সালে সংঘটিত যুদ্ধে মোঙ্গলগণ পুনরায় পরাজিত হন। তার সময় মোঙ্গল ও ইউরোপীয় সম্রাটদের সাথে কিছুটা বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক তৈরি হয়।
৫. গুপ্তঘাতকদের দমন : সিরিয়ার অভ্যন্তরে মারকাজ এবং হামার মধ্যবর্তী আল মারিফ পার্বত্য অঞ্চলে ইসমাইলীয় গুপ্তঘাতকদের ৯টি দুর্গ ছিল।
বাইবার্স ১২৭০-১২৭৩ সালের মধ্যে পরিচালিত কতিপয় দুর্ধর্ষ আক্রমণে কাদম্বুস, ক্যালিফ, মানিকা, খাওয়াইবি, মাসিয়াক, উয়াইকা প্রভৃতি দুর্গগুলো দখল করে নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড দুর্বল করে দেন।
৬. সুদান নীতি : সুদানের খ্রিস্টান শাসক দায়ুস বহুদিন থেকেই মিশরকে নিয়মিত কর প্রদান বন্ধ করে দেন। তাছাড়া মিশর সীমান্তে আক্রমণ করেও সে বহু মানুষকে বন্দি করে নিয়ে পিয়েছিল।
এই সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে বাইবার্স সুদানে অভিযান চালিয়ে দায়ুসকে অপসারিত করে সুদান দখল করে নেন।
৭. সামরিক সংস্কার : সুলতান বাইবার্স নতুন রাজ্য জয় এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধানে ব্যাপক সামরিক সংস্কার সাধন করেন। তিনি জায়গির প্রথা বাতিল করে সেনাবাহিনীকে কেন্দ্রীয়ভাবে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
তাছাড়া নৌবাহিনীর উন্নতির জন্য তিনি নতুন ৪০টি জাহাজ নির্মাণ করেন। এর ফলে তাঁর সামরিক বাহিনী নবচেতনায় উদ্ভাসিত হয়।
৮. বিচার বিভাগ : বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্য তিনি নাগরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি কায়রো দুর্গের পাদমূলে বিচারালয় নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। মিশরে তিনিই প্রথম সুলতান যিনি ইসলামের ৪ মাজহাবের জন্য ৪ জন ইমাম নিযুক্ত করেন।
৯. নৈতিকতার উন্নতি বিধান : সুলতান বাইবার্স সাম্রাজ্যের উন্নতির বিধানে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি প্রজাদের নৈতিকতার উন্নতির জন্য মদ্যপান, জুয়াখেলা, বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করে ইউরোপীয় রমণীদের রাজধানী থেকে বহিষ্কার করেন।
১০. গোয়েন্দা বিভাগ : সুলতান বাইবার্স সাম্রাজ্যের যাবতীয় খবরাখবর এবং বিরোধীদের গোপন তৎপরতা সম্পর্কে জানতে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করেন।
১১. স্থাপত্য শিল্পে অবদান : সুলতান বাইবার্স ছিলেন স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক, তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যে বহু ইমারত গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া কায়রোর প্রধান মসজিদটিতে ১২৬৯ সালে তিনি একটি অপূর্ব সুন্দর স্তম্ভ নির্মাণ করেন।
১২. ধর্মীয় নীতি : ধর্মীয় বিষয়ে সুলতান বাইবার্স ছিলেন যথেষ্ট উদার। তিনি নিজে ইসলামের বিধানাবলি যথাযথভাবে পালন করলেও অন্য ধর্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন না। তাঁর সময়ে তাঁর অর্থায়নে অনেকগুলো গির্জাও নির্মিত হয়েছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতান বাইবার্স ছিলেন একজন অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। ফলে অতি অল্প সময়ে তিনি নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে সামান্য ক্রীতদাস থেকে মামলুক বংশের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১২৬০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি মোঙ্গল ও ক্রুসেড হামলা প্রতিরোধ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, কৃষি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি বিধানের মাধ্যমে মামলুক সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠার মর্যাদা লাভ করেছেন। মামলুক সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধানে এবং সুসংহত করার জন্য তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।