মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আলোচনা কর
মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আলোচনা কর |
মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আলোচনা কর
- অথবা, মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিখ।
- অথবা, মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পৃথিবীর খুব অল্প রাজবংশই মিশরের মামলুক সুলতানদের ন্যায় খ্যাতি লাভে সমর্থ হয়েছিল। মামলুকগণ মিশরে প্রায় তিনশ বছর রাজত্ব করেন।
তাদের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে ইসলামের ইতিহাসে নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মহান সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মৃত্যুর পর মুসলিম জাহানের মহাদুর্দিনে মামলুকরা ইসলামকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।
আইয়ুবী বংশের ধ্বংসস্তুপের উপর আস-সালিহের বিধবা পত্নী শাজার-উদ-দার মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
এ মামলুক বংশের ক্ষমতায় আসা এবং দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে থেকে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
→ মামলুকদের বংশ প্রতিষ্ঠা : মামলুক একটি আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ ক্রীতদাস। বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতাসিম (১২৪২-১২৫৮) এর ন্যায় আইয়ুবী সুলতান মালিক আস-সালিহ ব্যাপকভাবে তুর্কি ক্রীতদাস সংগ্রহ করেন।
আল-সালিহ তাদের মধ্যে প্রতিভার সন্ধান পেয়ে এসের দ্বারা একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও দেহবাহিনী গঠন করেন।
১২৪৯ সালে মালিক আস-সালিহের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ১২৫০ সালে তারা মিশরের ক্ষমতা দখল করে নেন।
প্রথম জীবনে ক্রীতদাস বা মামলুক থাকায় তাদের প্রতিষ্ঠিত বংশ মিশরের মামলুক বংশ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, বাহারি মামলুকদের দ্বারাই মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মিশরে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাবলি : মিশরে মামলুকদের ক্ষমতাসীন হওয়ার ঘটনাবলি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. মামলুকদের মিশরে আগমন : মামলুকদের অধিকাংশ ছিলেন তুর্কিদের কুমান শাখার লোক। উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চল ছিল তাদের আদি বাসস্থান।
এক পর্যায়ে মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হয়ে তারা দলে দলের মাতৃভূমি ত্যাগ করে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মিশরে আগমন করেন। মিশরে মামলুকদের আগমন ইতিহাসের গতিধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
২. মিশরে মামলুকদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ : কিপচাক মামলুক তুর্কিগণ মিশরে আগমন করলে মিশরের আইয়ুবী বংশের সুলতান মালিক আস-সালিহ তাদের ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করেন।
এই সকল মামলুকদের সামরিক প্রতিভার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। তারা অসীম সাহসী, কষ্টসহিষ্ণু এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন।
তাদের এই সকল চারিত্রিক গুণাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ এদের দ্বারা একটি সামরিক ও দেহরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলেন। এক্ষেত্রে আস সালিহ উদ্দেশ্য ছিল মূলত খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের সাফল্যজনকভাবে মোকাবেলা করা।
৩. শাজার-উদ-দার কর্তৃক মামলুক বংশের সূচনা : ১২৪৯ সালে আইয়ুবী সুলতান আস-সালিহের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী শাজার-উদ-দার আস সালিহের পুত্র তুরান শাহ এর পক্ষে মিশরের ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
এর ফলে মিশরে মামলুক বংশের সূচনা হয়। কেননা, এই সময় মৃত সুলতান আস-সালিহের প্রথম স্ত্রীর পুত্র তুরান শাহ দামিয়েতার ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।
শাজার-উদ-দার আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিমের হেরেমের একজন ক্রীতদাস ছিলেন। পরে ঘটনাক্রমে শাজার-উদ-দার আইয়ুবী সুলতান আল-সালিহর হস্তগত হলে তিনি তাকে মুক্তি দিয়ে স্বীয় পত্নি হিসাবে গ্রহণ করেন।
শাজার-উদ-দার প্রথম জীবনে ক্রীতদাস থাকায় তার ক্ষমতা গ্রহণকে মিশরে মামলুক বংশের সূচনা- হিসেবে গণ্য করা হয়।
৪. তুরান শাহকে হত্যা : যুবরাজ তুরান শাহ দামিয়েতার ধর্মযোদ্ধাদের নেতা নবম লুইকে পরাজিত ও বন্দী করে কায়রো প্রত্যাবর্তন করেন এবং পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
কিন্তু উচ্চাভিলাষী শাজার-উদ-দার গোপন ষড়যন্ত্র করে মামলুক সেনাপতি বাইবার্সের সহযোগিতায় ১২৫০ সালের ২ মে ডুরান শাহকে হত্যা করেন। তুরান শাহই ছিলেন আইয়ূবী বংশের সর্বশেষ সুলতান।
৫. শাজার-উদ-দারের ক্ষমতা গ্রহণ : তুরান শাহের মৃত্যুর ফলে মিশরের সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে মামলুকগণ আস সালিহের বিধবা পত্নী শাজার-উদ-দারের প্রতিভা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে সিংহাসনে বসান।
আর এরই মাধ্যমে স্থায়ীভাবে মামলুক বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মামলুক সেনাপতি আমির আইবেক তার সহকারী নিযুক্ত হন।
তিনি তিন মাস যোগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। শাজার-উদ-দার নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন ও খুতবা পাঠের ব্যবস্থা করে সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করেন।
তবে আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহ তার সার্বভৌমত্ব বকৃতি না দিয়ে মিশরের আমিরদের বিদ্রূপ ও মৃদু তিরস্কার করে একটি পত্র লিখলে, সমস্ত ঘটনা নাটকীয় রূপ ধারণ করে।
৬. আইবেকের ক্ষমতা গ্রহণ : মামলুক আমিরগণ খলিফার পরে ভীষণ অপমানবোধ করেন এবং তারা শাজার উদ-দারকে সিংহাসনচ্যুত করে প্রধান সেনাপতি ইজ্জাতদিন আইবেককে ১২৫০ সালে পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
এসময় অবস্থা বেগতিক দেখে সুচতুর ও কুচক্রী শাজার-উদ-দার সুলতান আইবেককে বিবাহ করেন এবং রাজক্ষমতার অংশীদার হয়ে বসেন।
উচ্চাভিলাষী শাজার-উদ-দার ১২৫৭ সালে স্বামী আইবেককে হত্যা করে বসেন। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ আইবেক সমর্থকদের হাতে তিনিও নিহত হন।
৭. বাহারি মামলুক বংশের শাসনকাল : বাহারি মামলুক বংশের ২৪ জন সুলতান ১২৫০ থেকে ১৩৮২ সাল পর্যন্ত ১৩২ বছর মিশর শাসন করেন। সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক।
সুলতান কালাউন ছিলেন এই বংশের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শাসক। তবে সুলতান আল-নাসিরের রাজত্বকালে মামলুক সাম্রাজ্য উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছিল।
৮. বুরুজি মামলুক বংশের ক্ষমতা লাভ : বাহারি মামলুকনের রাজত্বের শেষ দিকে বুরুজি মামলুকগণ বিশেষ প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেন এবং ১৩৮২ সালে সর্বশেষ বাহারি মামলুক সুলতান আস-সালিহ হাজিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সাইফুদ্দিন বারকুকের নেতৃত্বে তারা একটি স্বতন্ত্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাসে এরা বুরুজি মামলুক নামে পরিচিত। বুরুজি মামলুকদের রাজত্বকাল ১৩৫ বছর (১৩৮২-১৫১৭) স্থায়ী হয়েছিল এবং তাদের সুলতানের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। ১৫১৭ সালে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম মিশর জয় করলে মিশরে বুরুজি মামলুক তথা মামলুক বংশের অবসান ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরে মামলুকদের আড়াইশত বছরের অধিক রাজত্বকালে ইসলামের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশেষভাবে উজ্জীবিত হয়।
মিশরে মামলুক শক্তির অভ্যুদয়ের ফলে মুসলমানদের পূর্বেকার সেই গৌরবোজ্জল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা পুনরুজ্জীবন লাভ করে অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।