মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ বা পটভূমি আলোচনা কর
মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ বা পটভূমি আলোচনা কর |
মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ বা পটভূমি আলোচনা কর
- অথবা, মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের কারণ বা প্রেক্ষাপট বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : মিশরে বুরুজি মামলুক বংশের বিশতম সুলতান কাসসুয়া আল-ঘুরির (১৫০১-১৫১৬) রাজত্বের শেষদিকে তুরস্কের অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের সাথে সিরিয়া আলেপ্পো নগরের উত্তরে অবস্থিত মারজ-ই-দাবিকের প্রান্তরে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা ছিল একান্ত আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত।
এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মিশরের মামলুক বংশের অবসান ঘটে এবং ইসলামের প্রাণকেন্দ্র কায়রো তুর্কি সাম্রাজ্যের একটি করদ প্রদেশে রূপান্তরিত হয়।
মারজ-ই-দাবিক যুদ্ধ ছিল মুসলিম বিশ্বের দিক পরিবর্তনের নির্দেশক। কারণ এ যুদ্ধের ফলে দুর্বল শাসকদের হাত থেকে শক্তিশালী মুসলিম শাসকদের হাতে চলে যায়।
→ মারা-ই-পানিকের যুদ্ধের কারণ/পটভূমি : মার-ই-কির যুদ্ধের কারণ বা পটভূমি নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. পূর্ববর্তী শাসনের জের : মিশরের পূর্ববর্তী মামলুক সুলতান কায়েতবের সাথে তুর্কি সুলতান বায়েজিসের উপর্যপুরি দুইবার যুদ্ধের ফলে এ সম্পর্কে জের পরবর্তীতে কানসু আল ঘুরি ও প্রথম সেলিমের রাজত্বকালেও বজায় থাকে, যদিও কাসে তবে এবং বায়েজিদের সমস্যা মিটে গিয়েছিল।
২. সেলিমের শিয়া বিরোধী মনোভাব : সেলিম ছিলেন অত্যন্ত উচ্চভিলাষী ও ধর্মান্ধ নরপতি। শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের প্রতি তিনি চরম ঘৃণ্য হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন।
তাই তিনি পারস্যের সাফাভী বংশের শিয়া নরপতি শাহ ইসমাইলকে ১৫১২ সালে আক্রমণ করেন। এবং কুর্দিস্তান ও সিয়ারবকর দখল করেন।
৩. আল ছুরির সাহায্যহীনতা : পারস্যের সাফাভী বংশের শিয়া নরপতি শাহ ইসমাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হওয়ায় তুর্কি সুলতান সেলিম মামলুক সুলতান আল-সুরির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হন। তাই সেলিম যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
৪. ঘুরির সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি : তুর্কি সুলতান সেলিম মামলুকদের করদ রাজ্য 'জুলকদর' আক্রমণ ও দখল করলে মামলুক সুলতান ঘুরি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং সিরিয়া সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করেন। কিন্তু সেলিম এটিকে যুদ্ধের হুমকি হিসাবে অভিহিত করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
৫. তুর্কি যুবরাজের আশ্রয়দান : মামলুক সুলতান আল-মুরি তুরস্কের কয়েকজন পলাতক বিদ্রোহী যুবরাজকে আশ্রয় দিয়ে তুর্কি সুলতান প্রথম সেলিমের বিরাগভাজন হন। সেলিম এ ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
৬. মামলুক সুলতান কর্তৃক চুক্তিভঙ্গ : তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিনের সাথে মামলুক সুলতান কায়েতবে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করে আল-ঘুরি এশিয়া মাইনরের তিনটি পূর্ণ দখল করলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
৭. মক্কা মদিনার অধিকার নিয়ে বিরোধ : এতদিন পর্যন্ত ইসলামের দুই পবিত্রভূমি মক্কা ও মদিনার রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি মামলুক সুলতানগণ সম্পাদন করতেন। কিন্তু তুর্কি সুলতান প্রথম সেলিম মক্কা ও মদিনা নিজের দখলে আনার মনস্থ করলে পরিস্থিতি জটিলকার ধারণ করে।
৮. কানসু আল-ঘুরির বড়যন্ত্র : মামলুক সুলতান কানসু আল ঘুরি অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের অভিযানের কথা বুঝতে পেরে পারস্যের শাহ ইসমাইল ও প্রথম সেলিমের মধ্যে সমঝোতা করার নামে শাহ ইসমাইলের পক্ষে গোপন ষড়যন্ত্র করেন।
কিন্তু অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের গোয়েন্দা বাহিনী কানসু আল ঘূবির অভিসন্ধি জানতে পেরে যায়। এর ফলে কানসু আল ঘুরি প্রথম সেলিমের প্রেরণকৃত দূতকে হত্যা করেন। ফলে প্রথম সেলিম রাগান্বিত হয়ে মিশর অভিযানে সৈন্য পরিচালনা করে।
৯. আল ঘুরির পতিশোধ স্পৃহা : সেলিমের অসৌজন্যমূলক আচরণে পঁচাত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ মামলুক সুলতান কাসসুয়া আল- ঘুরি ভীষণ অপমানবোধ করেন। ফলে যুদ্ধ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। ফলে মামলুক ও অটোমান তুর্কিদের মধ্যে পুনরায় রণদামামা বেজে উঠে ।
→ যুদ্ধের ঘটনাবলি : ১৫১৬ সালে ২৪ আগস্ট আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বেগ পূর্ব থেকেই সেলিমের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
ফলে তিনি যুদ্ধের প্রথম দিকেই সসৈন্য আল-ঘুরির দল ত্যাগ করেন যুদ্ধে অটোমান সৈন্য সংখ্যা মামলুকদের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল।
এছাড়া তুর্কি বাহিনী যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করেছিল। ফলে আল-ঘুরি বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেও যুদ্ধের গতি আয়ত্বে রাখতে পারেন নি।
বৃদ্ধ সুলতান আল-ঘুরি সহসা মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূপতিত হন। তার মস্তক ছিন্ন করে সেলিমের নিকট পাঠানো হয়। ফলে যুদ্ধে তুর্কিদের চূড়ান্ত বিজয় সম্পন্ন হয়।
উপসার : পরিশেষে বলা যায় যে, অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং মামলুক সুলতান আল-ঘুরির অদূরদর্শী নীতি মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের মূল কারণ। এটি ছিল একটি ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ।
কারণ এর ফলে মামলুক রাজত্বের চূড়ান্ত অবসান ঘটে এবং উত্থান হয় অটোমান খিলাফতের। মিশর তার এতদিনের গৌরব হারিয়ে করদ রাজ্যে পরিণত হয়।