মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা এবং পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসে এর প্রভাব আলোচনা কর
মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা এবং পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসে এর প্রভাব আলোচনা কর |
মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা এবং পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসে এর প্রভাব আলোচনা কর
- অথবা, মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা এবং ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিরূপণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল যুদ্ধ একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণকারী ছিল মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধ তন্মধ্যে অন্যতম।
কারণ এই যুদ্ধের ফলে ১২১৭ সালে শাজার-উদ- দারের প্রতিষ্ঠিত মামলুক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের একটি ছোট্ট প্রদেশে পরিণত হয়। এ যুদ্ধের পরই মিশরের সকল ক্ষমতা চলে যায় অটোমানদের হাতে ।
→ মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা : ১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট আলেপ্পোর উত্তরে অবস্থিত মারজ-ই-দাবিকের প্রান্তরে মামলুক ও অটোমান সৈন্যদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
যুদ্ধের পূর্বেই আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বেগ অটোমান সুলতান সেলিমের সাথে গোপন সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পন্ন করেন।
তাই যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মামলুক সেনাপ্রধান খায়ের বেগ আল কানসুয়ার দল ত্যাগ করেন। এ যুদ্ধে মামলুকদের তুলনায় অটোমানদের সৈন্যসংখ্যাও বেশি ছিল।
পাশাপাশি অটোমান বাহিনী এই যুদ্ধে নতুন কৌশল হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহার করেছিল। ফলে খায়ের বেগের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কানসুয়া আল-ঘুরি মরণপণ লড়াই করেও ব্যর্থ হন।
উপরম যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ সুলতান মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর খণ্ডিত মস্তক সুলতান সেলিমের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১২৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মামলুক বংশের চির সমাপ্তি ঘটে এবং মিশর অটোমান সালতানাতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
তুমান বের ক্ষমতা লাভ মামলুক সুলতান কানসুয়া আল ঘুরির মৃত্যুর পর তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় তাঁর ক্রীতদাস ও পোষ্যপুত্র তুমান বে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তুমান বে ছিলেন ঘুরির মতো সাহসী ও স্বাধীনচেতা। ফলে ১৫১৭ সালের ২২ জানুয়ারি কায়রোর মাঝারিয়া প্রান্তরে অটোমান ও মামলুকদের মধ্যে আবারও যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তুমান প্রাণপণে যুদ্ধ করেও পরাজিত হয় এবং কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিয়া শহরে পালিয়ে যায়। পরে তিনি শক্তি সঞ্চয় করে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে কায়রো শহর দখল করে কিছুদিন স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
ফলে অটোমান ও মামলুকদের মধ্যে পিরামিডের পাদদেশে আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তুমান বে জীবনপণ যুদ্ধ করেও পরাজিত হন এবং অটোমান বাহিনীর হাতে বন্দি হলে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এই ফাঁসির মধ্য দিয়ে মিশরে ১২৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মামলুক শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে তা এর অটোমান সালতানাতের অংশবিশেষে পরিণত হয়।
ইসলামের ইতিহাসে এর প্রভাব : ১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট মারজ-ই-নাবিকের প্রান্তরে সংঘটিত ঐতিহাসিক মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধ মিশরের পরবর্তী ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
কারণ এই যুদ্ধের ফলে মিশরে শাজার-উদ-দারের প্রতিষ্ঠিত ১২৫০ সালের মামলুক শাসনের অবসান ঘটে এবং মিশর অটোমান সালতানাতের ছোট প্রদেশে পরিণত হয়। তাছাড়া পরবর্তী ইতিহাসে এর অন্যান্য প্রভাবসমূহ ছিল নিম্নরূপ ।
১. মামলুক বংশের পতন : ১২৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত মামলুক বংশ ১৫১৬ সালের এই মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে মিশর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আরব উপদ্বীপ প্রভৃতি অটোমান সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
২. মক্কা-মদিনার কর্তৃত্ব লাভ : এতদিন মক্কা-মদিনার উপর মামলুকদের প্রভাব বজায় থাকায় মুসলিম বিশ্বের উপরও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।
কিন্তু ১৫১৬ সালের এই যুদ্ধের ফলে মক্কা-মদিনা শহর দুটির উপর অটোমানদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এবং এসব শহরের খুতবায় সেলিমের নাম উচ্চারিত হতে থাকে
৩. কায়রোর মর্যাদা হ্রাস : মামলুকদের রাজধানী হিসেবে কায়রো ছিল এতদিন এই অঞ্চলে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ১৫১৬ সালের মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধে মামলুকদের পরাজয়ের ফলে কায়রো শহরের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং কায়রো অটোমান সালতানাতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
৪. খিলাফতের পরিবর্তন : মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধে মামলুকরা পরাজিত হলে মিশরে ইসলামি খিলাফতেরও পরিবর্তন ঘটে।
কারণ বিজয়ী সেলিম শেষে আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলকে বন্দি করে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যান এবং তাঁর থেকে আয়া সোফিয়া মসজিদে খলিফার পদ গ্রহণ করেন। ফলে পতন ঘটে আব্বাসীয় খিলাফতের এবং আবির্ভাব ঘটে অটোমান সালতানাতের।
৫. অটোমানদের মর্যাদা বৃদ্ধি : ১৫১৬ সালের এই যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ফলে মক্কা ও মদিনা শহরের উপর অটোমানদের প্রভাব বৃদ্ধি . পায়। ফলে মুসলিম বিশ্বের কাছে অটোমানদের মর্যাদা বেড়ে যায়।
৬. অর্থনৈতিক উন্নতি : মারজ-ই-দাবিকের এই যুদ্ধে জয় অটোমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। এ সময়ে সিরিয়ার পতনের ফলে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম ১০০০ উঃ বোঝাই স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা লাভ করেন।
পাশাপাশি মিশর থেকে ১,৮০০ এর অধিক শিল্প কারিগরকে তিনি তুরস্কে নিয়ে আসেন। এছাড়াও তিনি মিশর থেকে নিয়মিত বাৎসরিক কর লাভ করতে থাকেন।
৭. উন্নত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন : প্রথম সেলিম মিশরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ঘুণেধরা মিশরের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য ২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করেন।
এই প্রদেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি একজন শাসকও নিয়োগদান করেন। ফলে এ মিশরবাসী তাদের পুরাতন ঘুণেধরা শাসনব্যবস্থার স্থলে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা লাভ করেন।
৮. জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন : মারাজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের | ফলে মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়। ফলে বিকাশ ঘটে উন্নত সভ্যতার। প্রথম সেলিম মিশর থেকে কারিগর ও জ্ঞানী-গুণীদেরকে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে এসেছিলেন।
তাদের সাথে ইউরোপের জ্ঞানী-গুণী এবং কারিগরদের সংমিশ্রণে তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রতিটি বংশেরই উত্থানের সাথে সাথে এর পতন রয়েছে নিশ্চিত। তেমনিভাবে ১২৫০ সালে শাজারের নেতৃত্বে যে মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন, তা দুর্বল উত্তরাধিকারদের সময় সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ফলে ১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট মারজ- ই-দাবিকের যুদ্ধে অটোমানদের নিকট পরাজিত হয়ে মামলুক বংশের পতনের চূড়ান্ত প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং ১৫১৭ সালে স্থায়ীভাবে পতন ঘটে ।