মামলুকদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর
মামলুকদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর |
মামলুকদের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে যে গুটি কয়েক বংশ অত্যন্ত হীন অবস্থা থেকে নিজেদের কর্মপ্রচেষ্টার বলে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিল মিশরের মামলুক বংশ তার মধ্যে অন্যতম।
সুলতান সালাহউদ্দিনের উত্তরাধিকারীদের অযোগ্যতা অদূরদর্শিতার জন্য যখন ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্ব ধ্বংসের ঠিক দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছিল ঠিক তখনই এই মুসলিম সম্প্রদায়কে আশু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১২৫০ সালে সুলতানা শাজার-উদ-দারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মামলুক বংশ। এ বংশটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে মিশরের শৌর্যবীর্য বৃদ্ধি করেছিল।
→ মামলুকদের পরিচিতি/ধারণা : আরবি মালাকা শব্দ থেকে মামলুক শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ দাস, শ্রমদাস, ক্রীতদাস ইত্যাদি। পূর্বে মিশরে যে সকল যুদ্ধবন্দীদের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করা হতো, পরে তারাই মামলুক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক ছিল, এই মামলুকদের আদি বাসস্থান। তারা ছিল তুর্কিদের কুমান শাখার অধিবাসী।
আইয়ুবী সুলতান মালিক আস সালিহ তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ব্যাপকভাবে তুর্কি ক্রীতদাসদের নিয়োগ দান করেন। যারা পরে তাঁর বাহিনীতে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠেছিল।
পরে তারাই রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেছিল এবং ১২৫০ সালে সুলতান মালিক আস সালিহ মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর বিধবা স্ত্রী শাজার উদ- দার তুরান শাসককে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
যেহেতু প্রথম জীবনে তিনি একজন ক্রীতদাসী ছিলেন তাই ১২৫০ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই বংশ মামলুক নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
→ মামলুক বংশের বিস্তারিত ইতিহাস : আইয়ুবী শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে ১২৫০ সালে তাদের ধ্বংসস্তূপের উপর মামলুক বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা চমকপ্রদ ঘটনা। নিম্নে মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত ইতিহাস আলোচনা করা হলো :
১. মামলুকদের উত্থান : মামলুকদের আদি বাসস্থান ছিল উরাল পর্বতমালা ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চলে। তারা ছিল তুর্কিদের কুমান শাখার অধিবাসী।
কিন্তু ক্রমাগত মোঙ্গল আক্রমণের ফলে জীবন রক্ষার তাগিদে মামলুকদের অনেক পূর্বপুরুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকার মিশরে আশ্রয় গ্রহণ করেন ।
২. সৈন্যবাহিনীতে যোগদান : আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্ত সিম ট্রান্স অক্সিয়ানা থেকে প্রচুর ক্রীতদাস এনে নিজ সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ দান করেন।
পরে তারই ধারাবাহিকতায় আইয়ুবী সুলতান মালিক আস সালিহ তাঁর সৈন্যবাহিনীতে প্রচুর সংখ্যক তুর্কি ক্রীতদাস নিয়োগ দান করেন। যারা পরবর্তীতে আইয়ুবী বংশের শক্তিশালী অংশে পরিণত হয়।
৩. মামলুকদের পদেপ্রতি : সুলতান মালিক আস সালিহ তাঁর সাম্রাজ্যের আরব ও মিশরীয় বাহিনীর প্রভাব হ্রাস করার জন্য মামলুকদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলেন।
পরে সুলতান তাদের রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ দান করেন। এর ফলে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে মামলুক বংশ।
৪. মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা : ১২৪৯ সালে আইয়ুবী সুলতান | মালিক আস সালিহ মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তখন তাঁর পুত্র তুরান শাহ দামিয়েতায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।
ফলে সুযোগ সন্ধানী সুলতান শাজার-উদ-দার তুরান শাহের পক্ষে শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রাথমিক জীবনে শাজার-উদ-দার আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাসিমের হেরেমে ছিলেন।
পরে তাকে মালিক আস সালিহের হেরেমে পুরস্কার হিসেবে পাঠানো হয়। সুলতান তাকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। সুলতানের উপর শাজারের প্রভাব ছিল অপরিসীম।
তাই সুলতানের মৃত্যুর পর তিনি কোনো বাধা ছাড়াই সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁর | প্রতিষ্ঠিত বংশ মামলুক বংশ নামে পরিচিতি লাভ করে।
৫. ডুরান শাহের হত্যা : পিতা সুলতান মালিক আল সালিহের মৃত্যুর সংবাদে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তুরান শাহ দামিয়েস্তার অভিযান শেষ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর বিমাতা শাজার-উদ-দারের ষড়যন্ত্রের কবলে নিপতিত হয়ে তিনি নিহত হন। শাজার-উদ-দার ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে মিশরের সিংহাসনে বসেন।
৬. সাজারের কূটকৌশল : এদিকে মাত্র তিন মাসকাল রাজ্য পরিচালনার পর শাজার-উদ-দার-এর শাসনের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
তাই এই আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য কূটকৌশলী শাজার-উন-দার কৌশলে ইজ্জাতদিন আইবেকের সেনাপতি বিয়ে করে তার অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
৭. আইবেককে হত্যা : এদিকে ইচ্ছাতদিন আইবেক মুইজউদ্দিন রাজনীতির কৌশল হিসেবে ১৯৫৭ সালে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেন।
কিন্তু এতে শাজার-উদ-দার মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং আইবেককে হত্যা করেন। পরে আইবেক সমর্থকগণ উত্তেজিত হয়ে শাজারকেও হত্যা করেন এবং তাঁর বালকপুত্র খলীলকে সিংহাসনে বসান।
কিন্তু ১২৫৮ সালে । সেনাপতি মোজাফফর সাইফুদ্দিন কুতুজ খলিলকে অপসারিত করে = নিজেই মামলুক সিংহাসনে বসেন।
৮. আইন-ই-জালুতের যুদ্ধ : মোগল কসাই হালাকু খান ১২৫৮ সালে বাগদাদে আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস করে মিশরের খলিফা কুতুজকে তাঁর বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানান। কিন্তু কুতুজ মোঙ্গল দূতকে হত্যা করে।
ফলে হালাকু খান মিশর আক্রমণে অগ্রসর হয়। মামলুক সেনাপ্রধান বাইবার্স হালাকু খানকে বাধা দান করলে ১২৫৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলুক ও মোঙ্গল বাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
প্রথমদিকে মোঙ্গল সাঁড়াশি আক্রমণে মামলুকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে শেষপর্যন্ত তারা মরণপণ লড়াই করে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য সুলতান আল কুতুজ বাইবার্সকে আলেপ্পোর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৯. বাইবার্সের ক্ষমতা লাভ : এদিকে সুলতান কুতুজ দিনে দিনে কামুক ও আরামপ্রবণ হয়ে উঠলে সেনাপ্রধান রুকনউদ্দিন বাইবার্স ১২৬০ সালে তাকে পদচ্যুত করে নিজেই মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন বাহারি মামলুকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন শাসক।
১০. বাহারি মামলুক : বাহারি মামলুক বংশ মিশরে ১২৫০- ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাহারি মামলুকরা শাসন করেন। তাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাণী শাজার-উদ-দার। এ বংশের মোট ২৪ জন শাসক ছিলেন।
কয়েকজন বিখ্যাত শাসক হলেন বাইবার্স, কালাউন আল নাসির ইত্যাদি। বাহারি মামলুকদের সর্বশেষ শাসক ছিলেন আস সালিহ হাজী।
১১. বুরুজির মামলুক শাসন : বাহারি মামলুকদের দ্বিতীয় বংশ ছিল বুরুজির মামলুক। বাহারি মামলুক সুলতান আল নাসিরের পর অদক্ষ-অযোগ্য সুলতানদের পরে ১৩৮২ সালে সুলতান আল বারকুকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বুরুজি মামলুক বংশ। এই বুরুজি মামলুক বংশ (১৩৮২-১৫১৭) খ্রি. পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আইয়ুবী সুলতানদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার সুযোগে সুলতান শাজার-উদ-দারের নেতৃত্বে ১২৫০ সালে মিশরে স্বাধীন মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এই মামলুক বংশের উত্থান ও পতন ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। কেননা, এ মামলুক বংশের সকলেই ক্রীতদাস ছিল।
তারা সামান্য ক্রীতদাস থেকে নিজেদের মেধা, প্রজ্ঞা, সাহস ও যোগ্যতাবলে রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মিশরে দীর্ঘদিন শাসন করেন।
তাদের এ শাসনের ফলে মুসলিম বিশ্ব খ্রিস্টানদের কাছে অন্যতম গুরুত্ব পায়। আর তাই মামলুকদের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।