মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর
মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর |
মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর
- অথবা, মিশরে মামলুক সুলতান আল নাসিরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
- অথবা, মিশরে মামলুক সুলতান আল নাসিরের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি রাজবংশে এমন কিছু শাসকের অভ্যুদয় ঘটে যারা নিজ মেধা, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার দ্বারা উক্ত রাজবংশকে খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন।
মিশরে প্রতিষ্ঠিত মামলুক বংশের সুলতান আল নাসির এমনই একজন শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন মামলুক শাসকদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শাসক এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার ফলে তাঁর সময় মামলুক বংশ খ্যাতির চূড়ান্ত পর্যায় উপনীত হয়েছিল ।
আল নাসিরের পরিচয় : মামলুক সুলতান কালাউনের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন আল নাসির। তাঁর মাতা ছিলেন একজন মোঙ্গল রাজকন্যা। সুলতান কালাউনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র খলিল আল আশরাফ সিংহাসনে আরোহণ করেন।
কিন্তু আল আশরাফের মৃত্যুর পর তাঁর কোনো সন্তান না থাকায় আমীর ওমরাহগণ তাঁর ভ্রাতা আল নাসিরকে আল মালিক আল নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ১২৯৩ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে সিংহাসনে।
সিংহাসন আরোহণ ও মেয়াদকাল : সুলতান আল নাসির ১২৯৩ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে সিংসাহনে আরোহণ করার পর তিনি দু'দুবার সিংহাসনচ্যুত হন।
তাঁর শাসনকাল ছিল ১৯৯৩- ১২৯৪, ১২৯৮-১৩০৮ এবং ১৩০৯-১৩৪০ সাল পর্যন্ত। ফলে তাঁর মোট রাজত্বকাল দাঁড়ায় দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর।
সুলতান আল-নাসিরের রাজত্বকাপ/কৃতিত্ব : নিম্নে সুলতান আল-নাসিরের রাজত্বকাল আলোচনা করা হলো :
১. মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ : সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকালে ১২৯৯ সালে মোঙ্গল সম্রাট গাজান খান অভিমান চালিয়ো জামমা উপ সুরুজ নামক স্থানে মামলুকদের পরাজিত করে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক অধিকার করে নেন।
পরে সুলতান নাসির তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করে ১০০২ সালে দামেস্ক পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। ১৩০৩ সালে মারজ উস সাফার যুদ্ধে মোঙ্গলদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে স্থায়ীভাবে মিশর থেকে বিতাড়িত করেন।
২. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন : আবার নাসির তাঁর সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে মনোনিবেশ স্থাপন করেন। তিনি বিদ্রোহাত্মক কাজের জন্য লেবাননের চরমপন্থি শিয়া বিদ্রোহী এবং সিরিয়ার ম্যারোনাইটগণকে ফাঁসি দেন এবং কায়রোয়ানের শিয়া সম্প্রদায় ও প্রজদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর এসকল ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে রাজ্যের বিদ্রোহ দূর হয়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসে ।
৩. কূটনৈতিক শক্তি স্থাপন : সুলতান আল নাসির যুদ্ধের পরিবর্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্ভাব প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
তিনি বাইজান্টাইন সম্রাট, কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট, রোমের ধর্মগুরু পোপ, ফ্রান্সের সম্রাট ষষ্ঠ ফিলিপ, মরক্কো, পশ্চিম আফ্রিকা এবং আবিসিনিয়ার সাথে সুষ্ঠু কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
৪. খ্রিস্টান নীতি : সুলতান আল নাসিরের রাজত্বের প্রথমদিকে খ্রিস্টানগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালালে তিনি অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু গির্জা ধ্বংস করে দেন।
তাছাড়া খ্রিস্টানদের নীল উৎসবেও তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পরে খ্রিস্টান সম্প্রদায় উক্ত ষড়যন্ত্র বন্ধ করে দিলে, তিনিও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করেন।
৫. ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি : সুলতান আল নাসির সাম্রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি বিধানে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
তাঁর যুগোপযোগী প্রচেষ্টার ফলে এ সময় মিশরের সাথে ইউরোপ মহাদেশে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেরও সূচনা হয় ।
৬. রাজস্ব সংস্কার : আল নাসির রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থারও ব্যাপক সংস্কারসাধন করেন । তিনি রাজ্যে প্রচলিত সকল অযৌক্তিক কর বিলুপ্ত করে দেন। রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপের ব্যবস্থা করে রাজস্ব নির্ধারণের ব্যবস্থা করেন।
রাষ্ট্রের সমস্ত জমিকে তিনি ২৪টি ভাগে বিভক্ত করেন। এর মধ্যে ১০টি রাষ্ট্রের জন্য এবং বাকি ১৪টি আমির ওমরাহ ও সৈন্যবাহিনীর জন্য বরাদ্দ করেন।
৭. কৃষির উন্নতি : সুলতান মালিক আল নাসির কৃষির উন্নয়নের জন্য নীলনদের সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার যোগাযোগ হিসেবে একটি দীর্ঘ খাল খনন করেন ।
এর ফলে প্রচুর অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আসে। তাছাড়া তিনি নীলনদে একটি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে ফসলাদি রক্ষার ব্যবস্থা করেন।
৮. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক : মামলুক সুলতানদের মধ্যে সুলতান আল নাসির ছিলেন ব্যাপক শিক্ষানুরাগী। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে তিনি এর ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁর রাজদরবারে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চক্ষু বিশেষজ্ঞ - সালাহউদ্দিন, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক আবুল ফিদা। তাছাড়া তাঁর রাজত্বকালে অসংখ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানও নির্মাণ করা হয় ।
৯. সাংস্কৃতিক সংস্কার : মামলুক সুলতানদের মধ্যে সুলতান আল নাসির ছিলেন প্রচণ্ড সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। তাই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, তীরন্দাজ, মল্লক্রীড়া, শিকার, ঘোড়সওয়ার, উদ্যান ও ললিতকলা চর্চা ইত্যাদির জন্য তার শাসনকাল বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরে মামলুক শাসকদের মধ্যে সুলতান আল নাসির ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ তাঁর সময় মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
তাঁর দীর্ঘ ৪২ বছরের রাজত্বকালে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, কর্মস্পৃহা, অধ্যবসায়, রণনিপুণতা ও দূরদর্শিতার জন্য মামলুক সাম্রাজ্য খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করে ।