লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সংস্কার গুলি বিশ্লেষণ কর
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সংস্কার গুলি বিশ্লেষণ কর |
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সংস্কার গুলি বিশ্লেষণ কর
- অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সংস্কারগুলো মূল্যায়ন কর।
- অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সংস্কারগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দাও।
- অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের কল্যাণমূলক সংস্কারগুলো আলোচনা কর।
- অথবা, উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সংস্কারসমূহের বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক গৌরবময় অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। ইতোপূর্বে যে সমস্ত গভর্নর জেনারেল ভারতবর্ষে শাসন করেন তাদের মধ্যে বেন্টিঙ্ক ছিলেন অন্যতম।
উদারপন্থি, শান্তিকামী, নির্ভেজাল, সংস্কারক এক মুক্ত প্রতিযোগিতার অধিকারী হিসেবে বেন্টিঙ্ক ছিলেন ভিক্টোরিয়ান যুগের মূর্তপ্রতীক।
তিনি শাসক হিসেবে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে শাসকবর্গের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে-এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি ভারতে বহুবিধ সংস্কারমূলক কাজে ব্রত হন।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সংস্কারমূলক কার্যাবলি : লর্ড বেন্টিঙ্কের সংস্কার কার্যাদিকে চারটি ভাগে ভাগ করে যায়। এগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
(ক) অর্থনৈতিক সংস্কার : লর্ড বেন্টিঙ্কের পূর্ববর্তী বিভিন্ন শাসকদের যুদ্ধ পরিচালনার কারণে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য হয়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে তিনি নিম্নরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ।
১. সামরিক ও বেসামরিক ব্যয় হ্রাস : তিনি সামরিক ও বেসামরিক ব্যয় হ্রাস করার জন্যে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শাস্তির সময়ে সামরিক কর্মচারীদের যে অর্ধেক ভাতা দেয়ার প্রথা ছিল তা তিনি উঠিয়ে দেন।
তিনি উচ্চশ্রেণির বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করেন। এই সমস্ত কার্যকলাপের জন্যে তিনি কর্মচারীদের নিকট অপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
২. কর্মচারী ছাঁটাই : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কোম্পানির কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে গোপন সংবাদ দেয়ার ব্যবস্থা করেন এবং প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজদের ছাঁটাই করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করেন।
৩. রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা : লর্ড বেন্টিঙ্ক মালবে উৎপন্ন আফিমের ওপর শুল্ক ধার্য করেন। যে সমস্ত জমি অবৈধভাবে নিষ্কর বলে দেখানো হয়েছিল সেগুলোর ওপর তিনি উপযুক্ত কর বসান।
(খ) শাসন সংক্রান্ত সংস্কার : লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসন সংক্রান্ত সংস্কার সম্পর্কে নিচে তুলে ধরা হলো ।
১. বিচার বিভাগের সংস্কার : বেন্টিঙ্ক কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং আপিল আদালতগুলো তুলে দিয়ে বিচারকার্যে সমন্বয় সাধন করেন।
তিনি বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ২০টি বিভাগে বিভক্ত করে প্রতিটি বিভাগে একজন করে কমিশনার নিযুক্ত করেন। ফলে কোম্পানির শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর হয়ে ওঠে।
২. ভারতীয়দের বিচার বিভাগে নিয়োগ : পূর্বে বিচার ব্যবস্থায় ভারতীয়দের নিযুক্ত করা হতো না। বেন্টিঙ্ক এই নিয়ম পরিবর্তন করে সর্বপ্রথম ভারতীয়দেরকে বিচার ও শাসন বিভাগের উচ্চপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ফারসি ভাষার পরিবর্তে তিনি আদালতে দেশীয় ভাষার প্রচলন করেন।
৩. জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন : লর্ড বেন্টিঙ্ক সর্বপ্রথম ১৮৩২ সালে জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং সেখানে ভারতীয়দের নিয়োগদানের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া তার সময় থেকেই আইন লিপিবন্ধ হতে শুরু হয়।
(গ) সামাজিক সংস্কার : লর্ড বেন্টিঙ্কের সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কর্ম হলো সামাজিক সংস্কার।
নিচে তার সামাজিক সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. সতীদাহ প্রথার বিলোপ : লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতীয় সমাজব্যবস্থা থেকে কুখ্যাত সতীদাহ প্রথা বিলোপ সাধন করে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সম্রাট আকবর, কর্নওয়ালিশ, লর্ড মিন্টো, হেস্টিংস প্রমুখ সকলেই হিন্দুসমাজে প্রচলিত সহমরণ ও অনুসরণ প্রথা বন্ধ করতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। অতঃপর রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ উদারপন্থি হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাহায্যে লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা রহিত করেন এবং বলপূর্বক বিধবাদের সহমরণে বাধ্য করাকে আইনত দণ্ডনীয় বলে আইন জারি করেন।
২. ঠগী দমন : মুঘল সম্রাট আকবরের সময় হতে শুরু করে কোম্পানির শাসন আমল পর্যন্ত ঠগীরা ভারতবর্ষে সর্বত্র খুন, রাহাজানি দ্বারা ত্রাসের সৃষ্টি করে। অতর্কিত আক্রমণে পথিকদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তাদের অর্থ ও জিনিসপত্রাদি আত্মসাৎ করাই ছিল ঠগীদের উপজীবিকা।
বেন্টিঙ্ক কর্নেল শ্রীম্যানকে ঠগী দমনের ভার অর্পণ করলে তিনি ফিরিঙ্গি নামক জনৈক ঠগীর নিকট হতে ঠগীদের গোপন ঘাঁটিগুলো সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে কঠোর হস্তে ১৮৩০ সালে তাদেরকে দমন করেন।
(ঘ) শিক্ষা সংস্কার : শিক্ষা সংস্কার লর্ড বেন্টিঙ্কের আর একটি কৃতিত্বপূর্ণ কাজ।
নিচে তার শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন : পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন লর্ড | বেন্টিঙ্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৮১৩ সালের সনদ অনুসারে কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বাৎসরিক কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য ছিল।
এই অর্থ কেবল সংস্কৃত ও ফারসি প্রভৃতি প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হতো। তিনি ১৮৩৩ সালে এই অর্থ পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে বায়ের সিদ্ধান্ত নেন।
২. মেডিকেল কলেজ স্থাপন : ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কের চেষ্টায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও বোম্বাই-এর এলফিন স্টোন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষা সভ্যতার অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত হয়। তিনি সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা লাঘব করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে লর্ড বেন্টিঙ্কই একমাত্র শাসক তিনি ভারতবাসীর বিভিন্ন সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
আর এ উপলব্ধি থেকেই তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ সাধন করেছেন এবং ভারতবাসীর কল্যাণ সাধন করেছেন। তাই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক গৌরবোজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছেন।