লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর সামাজিক সংস্কার বর্ণনা কর
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর সামাজিক সংস্কার বর্ণনা কর |
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর সামাজিক সংস্কার বর্ণনা কর
- অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামাজিক সংস্কারসমূহ সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
- অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামাজিক সংস্কারসমূহের আলোকে বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : পৃথিবীতে চিরস্থায়ী বলতে কিছু নেই। সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তবে একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, বেনিয়ারা ভারতের নিয়ন্ত্রণকর্তা হন।
আর কোম্পানি তাদের আধিপত্য কায়েম করে ভারতে প্রতিনিধিত্ব শাসন কায়েম করেন। এভাবে কোম্পানি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে লর্ড আমহাস্টের পর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতবর্ষে আসেন গভর্নর জেনারেল হিসেবে।
বেন্টিঙ্কই একমাত্র গভর্নর জেনারেল যিনি বলেছিলেন, ভারতীয়দের নৈতিক উন্নতি সাধনই ব্রিটিশ সংস্কারের একমাত্র লক্ষ্য। তাই বেন্টিক ভারতীয়দের উন্নয়নের জন্য সংস্কারমূলক কার্য সম্পাদন করেন।
→ সামাজিক সংস্কারসমূহ : লর্ড বেন্টিঙ্কের সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কর্ম হলো সামাজিক সংস্কার। তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারমূলক কাজ করে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন।
নিচে তার সামাজিক সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. সতীদাহ প্রথার বিলোপ : লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতীয় সমাজব্যবস্থা থেকে কুখ্যাত সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বহুকাল থেকেই হিন্দুসমাজে সহমরণ ও অনুসরণ প্রথার প্রচলন ছিল।
অনেক সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনরা লোকাচার রক্ষার জন্যে বিধবা স্ত্রীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুড়িয়ে মারত। এই অমানুষিক শান্তিদান প্রথায় ব্যথিত হয়ে বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালে এর বিলোপ সাধন করেন।
এ ব্যাপত্র বেন্টিঙ্ক রাজা রামমোহন রায় ও প্রিন্স দ্বারকানাথ রায় নামক দুইজন ভারতীয় সমাজ সংস্কারকের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে।
২. শিশুহত্যা নিষিদ্ধ ঘোষিত : তৎকালীন হিন্দুরীতি অনুযায়ী দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রথম সন্তানকে পঙ্গায় নিক্ষেপ এবং বিবাহ দেবার অক্ষমতাহেতু শিশু কন্যাকে গলা টিপে হত্যা করার প্রথাও তিনি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
সম্রাট আকবর, লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং মিন্টোর সময়ও এটা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু এর কার্যকারিতা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। লর্ড বেন্টিঙ্ক এই কুখ্যাত প্রথা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি আইন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন।
৩. ঠগী দস্যুদের দমন : ঠগী দমন বেন্টিঙ্কের আর একটি উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কার। মুঘলদের পতনযুগে ঠগী নামে এ দস্যুদল ভারতের সর্বত্র ত্রাসের সৃষ্টি করে।
এরা ছদ্মবেশে তীর্থযাত্রা ও পথিকদের অনুসরণ করত। এ সুযোগ পেলেই তাদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে সর্বস্ব লুণ্ঠন করত।
লর্ড বেন্টিঙ্ক ঠগী দমন করার জন্যে কর্নেল শ্রীম্যানের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। ১৮৩০ সালে শ্রীম্যান উপীদের কঠোর হস্তে দমন করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন।|
৪. ভারতীয়দের বিচার বিভাগে নিয়োগ : পূর্বে বিচারব্যবস্থায় ভারতীয়দের নিযুক্ত করা হতো না। বেন্টিঙ্ক এই নিয়ম পরিবর্তন করে সর্বপ্রথম ভারতীয়দেরকে বিচার ও শাসন বিভাগের উচ্চপসে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
তিনি ভারতীয়দের মধ্যে সাব জজ পদের সৃষ্টি করেন। ফারসি ভাষার পরিবর্তে তিনি আদালতে দেশীয় ভাষার প্রচলন করেন।
৫. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন : পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন লর্ড বেন্টিঙ্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি। ১৮১৩ সালের সনদ অনুসারে কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্যে বাৎসরিক কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য ছিল।
এই অর্থ কেবল সংস্কৃত ও ফারসি প্রভৃতি প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্য বায় করা হতো। তিনি ১৮৩৩ সালে এই অর্থ পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে বায়োর সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু এই সময় এক দল লোক তার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। অবশেষে এদেশে বেন্টিঙ্কের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সিদ্ধান্তকে কল্যাণকর মনে করে মেনে নেয়া হয়।
৬. সংবাদপত্রের অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত : সংবাদপত্রকে সমাজের দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমে | জনসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি দাওয়া প্রতিফলিত হয় বেশি মাত্রায়।
কিন্তু ভারতীয় জনসমাজের ন্যায্য দাবি পাওয়া আদায়ের পথ রুদ্ধ করার জন্য পূর্ববর্তী গভর্নর জেনালেররা সংবাদপত্রের উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করে এক প্রকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন।
কিন্তু বেন্টিঙ্ক সংবাদপত্রের উপর থেকে বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল করে সংবাদপত্রের আবদ্ধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত করেন। এর ফলে ভারতীয় সমাজের মনোজগতে এক বিরাট পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
৭. দ্রুত বিচারকার্য সমাধান : মামলা মোকদ্দমার বিচার বিলম্বিত হওয়ায় ভারতীয় জনসমাজ বিভিন্ন দিক দিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল। লর্ড বেন্টিঙ্ক দ্রুত বিচারকার্য সমাধানের জন্য ১৮২৯ সালে রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কমিশনার নিযুক্ত করেন।
১৮২৯ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে তিনি ম্যাজিস্টেটদের অপরাধীকে দুই বছরের শক্তি প্রদান করার ক্ষমতা প্রদান করেন। 'এভাবে তিনি মামলা মোকদ্দমার দ্রুত নিষ্পত্তি করে সুষ্ঠু রায় প্রদানের ব্যবস্থা করে ভারতীয়নের সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, একজন সংস্কারক হিসেবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নাম ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। ভারতীয় প্রজাদের মানসিক ও নৈতিক উন্নতির চেষ্টা করে তিনি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন।
ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজ সরকারের নৈতিক দায়িত্বের কথা উপলব্ধি করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লিখিত সংস্কারসমূহ সাধন করে এক অভাবনীয় প্রতিভা ও সমাজসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভারতবাসীর নিকট শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হয়ে রয়েছেন।