ইসলামের ইতিহাসে ক্রুসেডের গতিপ্রকৃতি আলোচনা কর
ইসলামের ইতিহাসে ক্রুসেডের গতিপ্রকৃতি আলোচনা কর |
ইসলামের ইতিহাসে ক্রুসেডের গতিপ্রকৃতি আলোচনা কর
- অথবা, ইসলামের ইতিহাসে ক্রুসেডের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : মুসলমানদের প্রতি খ্রিস্টানদের বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে। পবিত্রভূমি জেরুজালেম রক্ষার জন্য খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মাঝে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর যাবত স্থায়ী হয় যুদ্ধ। জেরুজালেম রক্ষার জন্যই মুসলমানদের এবং খ্রিস্টানদের মাঝে বারবার এ যুদ্ধ হয়।
এ যুদ্ধে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে এবং মুসলমানদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধের পেছনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনেকগুলো কারণ থাকলেও ধর্মীয় কারণ ছিল প্রধান। পৃথিবীর ইতিহাস ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ অন্যতম এক আলোচ্য বিষয় ।
ক্রুসেডের গতিপ্রকৃতি : দিতে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আলোচনা করা হলো :
প্রথম যুদ্ধ : ১০৯৫ থেকে ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত সময়কাল ছিল প্রথম যুগ। এ সময়ে খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাগণ মুসলিম রাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং আতাবেগ জঙ্গির এডিসা পুনরুদ্ধার পর্যন্ত প্রথম ক্রুসেড স্থায়ী হয়।
দ্বিতীয় যুগ : ১১৪৪ থেকে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত স্থায়ী এ যুগ। এ সময়টি ছিল ইমামুদ্দিন জঙ্গি থেকে শুরু করে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর শাসনকাল পর্যন্ত সময়।
তৃতীয় যুগ : ১১৯৩ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী ছিল এ যুগ। এ সময়ে বিভিন্ন গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
→ প্রথম পর্যায় : (১০৯৫-১১৪৪) ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে প্রথম পর্যায়ে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানির ধর্ম যোদ্ধাগণ ওল্টার পিটার গওফ্রে, বোমেমণ্ডের ও বলডুইনের নেতৃত্বে এশিয়া মাইনর দখল করে।
তারপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অভিযান প্রেরণ করেন তারা। অভিযানে ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে এডিমা ও এন্টিও দখলে নেয় তারা।
পরে পিটার গওফ্রের নেতৃত্ব ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম খ্রিস্টানদের অধিকারে আসে। এরপর তারা মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করে। এন্টিওকে তারা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
১. রাজ্য দখল : ১১০১ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে খ্রিস্টান রাজা বলতুই একে একে জাফা আক্কা, সিওন এবং বৈরুত দখল করেন। এর আগে ত্রিপলিও খ্রিস্টানরা তাদের অধিকারে নিয়ে নেয়।
২. চার ল্যাটিন রাষ্ট্র : মুসলিম রাজ্যে ক্রুসেডের ফলে চারটি ল্যাটিন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যথা : এডিসা, এনিউওক, ত্রিশলি এবং জেরুজালেম।
ক্রুসেডদের দমন : ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ইমামুদ্দিন জঙ্গির আবির্ভাব ক্রুসেডদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি প্রথম ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন।
পরে ধারাবাহিকভাবে আলেপ্পো হাররান এবং মসুল দখলে নেন। এতে ক্রুসেডাররা আতঙ্কিত হয়। ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এডিসা পুনরুদ্ধার করেন এবং খ্রিস্টানদেরকে সিরিয়া হতে বিতাড়িত করেন।
দ্বিতীয় পর্যায় : (১১৪৪-১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে) : জঙ্গি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইমামুদ্দিনের সাহসী পদক্ষেপ মুসলমানরা বিজয়ের মুখ দেখতে পায়। তার সাহসিকতার কারণে বাগদাদ খলিফা তাকে আতাবেগ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১. ক্রুসেডারদের প্রতিরোধ : তিনি আতাবেগ উপাধি ধারণ করে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২. খ্রিস্টানদের এডিলা দখল : ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে এভিসা দখলে নেয় খ্রিস্টানরা কিন্তু ইমামুদ্দিনের আমলে তাদের পতন হলে খ্রিস্টানদের মাঝে আতঙ্কে সৃষ্টি হয়। পরে ইমামুদ্দিনের ছেলে নুরুদ্দিন জঙ্গি আলেপ্পোর সিংহাসনে আরোহণ করলে খ্রিস্টানরা পুনরায় এভিসা দখলে নেয়।
৩. দ্বিতীয় ক্রুসেড : এডিসা দখল করে খ্রিস্টানরা সেন্ট বার্নাডের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ক্রুসেড ঘোষণা করেন। এ সময় জার্মান ও ফরাসি টেম্পলার ও হসপিটালারদের একটি বিরাট বাহিনী মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
৪. মুসলমানদের এডিসা জয় : যুদ্ধে নুরুদ্দিনের সাথে খ্রিস্টানরা পরাজিত হয় এবং তিনি বীর বিক্রমে এভিসা পুনরুদ্ধার করেন এবং জেরুজালেম ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলগুলো পুনরাধিকার করেন। এভাবে দ্বিতীয় ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটে।
৫. সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বংশ : ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী ফাতেমীয় বংশের পতন ঘটিয়ে আইয়ুবী বলে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
৬. জেরুজালেম দখল : সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্ষমতায় বসে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। হিট্রিনের যুদ্ধে ২০ হাজার ফ্রাঙ্ক সৈন্যসহ ফ্রাঙ্কনেতা রেজিন্যান্ড সালাহউদ্দিন নিকট বন্দি জন এবং প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরে জেরুজালেম রাজা গীদ্যাকসিনাও তার হাতে বন্দি হন। এভাবে তিনি জেরুজালেম দখলে নেন।
৭. তৃতীয় ক্রুসেড : জেরুজালেম পতনের পর খ্রিস্টানরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। তারা ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড জার্মানির রাজা ফ্রেডরিক বারবারোসা এবং ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস মিলে তৃতীয় ক্রুসেও পরিচালনা করেন।
ফ্রেডরিক স্থলপথে একটি সিলিসিয়ান নদীতে ডুবে মারা যান। অন্যদিকে রিচার্ড ও অগাস্টাস প্রাণপন চেষ্টা করেও জেরুজালেম উদ্ধার করতে না পেরে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিনের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিনের মৃত্যুতে তৃতীয় ক্রুসেড পরিসমাপ্তি ঘটে।
তৃতীয় পর্যায় : (১১১৯৩-১১৯১ খ্রিস্টাব্দ) ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় ১০০ বছর এটি স্থায়ী হয়।
১. চতুর্থ ক্রুসেড : ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর মৃত্যুর পর পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট ১১৯৫ সালে চতুর্থ ক্রুসেড ঘোষণা করেন। তিনি প্যালেস্টাইনসহ সমগ্র ইউরোপে আন্দোলন চালান।
তারা জলপথে এসে বৈরোত অবরোধ করে। অবশেষে সালাহউদ্দিন ভাই মালেক আল আদিলের হাতে পরাজিত হন এবং একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে তারা এ সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন।
২. পঞ্চম ক্রুসেড : তিন বছর পর ১২০০ খ্রিস্টাব্দে অর্থলিলায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট পঞ্চম ক্রুসেড পরিচালনা করেন। তারা আক্রমণ করে অসংখ্য নর-নারী ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অনেক ক্ষতিসাধন করে। আটদিন যাবত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ব্যাপক ধনসম্পদ লুট করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে।
ষষ্ঠ ক্রুসেড : ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় দুই লক্ষ সৈন্যবাহিনী নিয়ে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট প্রথমে সিরিয়া যায়, সেখান থেকে মিশর ও ডালমেটিয়া আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
এ সময় তারা প্রায় সত্তর হাজার অধিবাসীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় টিকতে না পেরে বিপর্যস্ত অবস্থায় ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে চলে যেতে বাধ্য হয়।
৪. সপ্তম ক্রুসেড : ষষ্ঠ ক্রুসেডের আট বছর জার্মানির সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডারিক পুনরায় ক্রুসেডের প্রস্তুতি নেয়। এটি সপ্তম ক্রুসেড নামে পরিচিত। ফ্রেডারিক ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া উপস্থিত হন।
কিন্তু আক্রমণের সাহস করতে না পেরে ১০ বছর ১০ মাস ১০ দিনের একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে মিশরের কর্তা কামিল মারা গেলে তার পুত্র আবু বকর মালেক উল আদিল সিংহাসনে বসেন। একই বছর হাররানের অধিপতি আবুনসর দাউদ জেরুজালেম পুনরাধিকার করেন।
৫. অষ্টম ক্রুসেড : ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের নবম লুইয়ের নেতৃত্বে অষ্টম ক্রুসেড সংঘটিত হয়। তার নেতৃত্বে খ্রিস্টানরা মিশর আক্রমণ করে। কিন্তু আইয়ুবের পুত্র তুরান শাহের নিকট তিনি পরাজিত হন।
প্রকাশ্য আক্রমণের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চলগুলো ১২৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরুদ্ধার করেন। এভাবে অষ্টম ক্রুসেড শেষ হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এটি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ।
এ যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হলেও বারবার আক্রমণে মুসলমানদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। অসংখ্য মুসলমানের প্রাণহানি ঘটেছে।
খ্রিস্টানরা বারবার আক্রমণ করে মুসলমানদের পরাজিত করতে চাইলেও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে তারা বারবার পরাজিত হন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আইয়ুবী বংশ মুসলমানদের গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল।