ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলো কি কি আলোচনা কর
ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলো কি কি আলোচনা কর |
ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলো কি কি আলোচনা কর
- অথবা, ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর : ভূমিকা : প্রত্নতত্ত্ব অর্থ পুরাতন বিষয়ক জ্ঞান। প্রচলিত ধারণায়, বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনর্নির্মাণ করার বিজ্ঞানকেই প্রত্নতত্ত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
অতীতের সংস্কৃতি ও পরিবেশ নিয়ে চর্চা করে এমন অন্যান্য বিজ্ঞান বা বিষয়গুলোর মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিশেষত্ব হলো, এটি কেবল বস্তুগত নিদর্শন অর্থাৎ প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে কাজ করে এবং তার সাথে মানুষের জীবনধারার সম্পর্ক নির্ণয় করে।
প্রত্নতত্ত্বের মূল উপজীব্য হলো ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রত্নতত্ত্বের চর্চার বিকাশ লাভ করে মূলত আঠারো শতকে। বাংলায় প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সূচনা হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। তাম্রশাসন, মুদ্রা, শিলালিপি, ভাস্কর্য ইত্যাদি ইতিহাসে অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
— ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ : প্রত্নতত্ত্বের উপাদানসমূহ থেকে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর জীবনধারা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
নিম্নে ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. লিপি : ইতিহাসের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হলো লিপি। পাথর, তামা, লোহা, পোড়ামাটির উপর খোদাই করা লিপি থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়।
সেজন্য লিপিকে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল বলা হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের ভাষা ও বক্তব্যের পরিবর্তন হলেও লিপি সবসময় অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ তথ্য বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম। লিপি মূলত দুই প্রকার। যথা-
(ক) দেশীয় লিপি : ব্রাহ্ম, তামিল, গালি, খরোষ্ঠী, প্রাকৃত প্রভৃতি ভাষায় লেখা প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলোর প্রধান বিষয়বস্ত ছিল ভারতীয় রাজাদের রাজ্যজয়, ভূমিদান, শাসন, ধর্ম, রাজনৈতিক ঘটনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি। প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলোর মধ্যে অশোকের শিলালিপি, এলাহাবাদ প্রশস্তি, দেওপাড়া লিপি অন্যতম।
(খ) বিদেশি লিপি : এশিয়া মাইনর, কম্বোডিয়া, চম্পা, যবদ্বীপ, গ্রিস, পারস্য প্রভৃতি বৈদেশিক অঞ্চলগুলো থেকে পাওয়া লিপিগুলো থেকে এইসব অঞ্চলগুলোর সাথে প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে লিপিকে প্রথম স্থানে রেখেছেন।
২. অভিলেখমালা : প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো অভিলেখমালা। তাম্রফলকে অঙ্কিত তৎকালীন ভূমি লেনদেন সংক্রান্ত দলিলাদি যা মূলত তাম্রশাসন নামেই অভিহিত।
এগুলোকে অভিলেখমালার অন্যতম উৎস হিসেবে মনে করা হয়। বাংলায় প্রাচীনতম লিপি ব্রাজিলিপিতেও উৎকীর্ণ অভিলেখটিই বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অন্যতম প্রমাণ ।
৩. প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ : প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংশাবশেষ। এগুলোর মাঝে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়, নওগা জেলার পাহাড়পুর, নরসিংদী জেলার ওয়ারি-বটেশ্বর, সাতক্ষীরা জেলার জাহাজঘাটা হাম্মাম খানা, কুমিল্লা জেলার ময়নামতি অন্যতম।
এসব প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষসমূহ আমাদের অতীত সমাজ জীবন, সভ্যতার সাথে পরিচিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
৪. মুদ্রা : রাজার নাম ও সাল তারিখ মুদ্রা থেকে জানা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও ধাতুবিদ্যার উৎকর্ষতা মুদ্রা মারফত জানা যায়। মুদ্রার অঙ্কিত চিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন রাজার গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
যেমন- সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে তার সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ সম্পর্কে জানা যায়। ব্যাকট্রীয়, গ্রিক, শক, কুষাণ, গুপ্ত রাজাদের কাহিনি মুদ্রা থেকেই জানা যায়।
সাতবাহন সাম্রাজের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মুদ্রা। মৌর্য যুগে ছাপাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলিত ছিল। এগুলো সবই ইতিহাসের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
৫. স্থাপত্য : স্থাপত্য হলো দালান এবং অন্যান্য বাস্ত কাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা, নকশা এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া বা কাজ। স্থাপত্য দালানের মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেন।
যা সাংস্কৃতিক প্রতীক বা শিল্পকর্ম হিসেবে অনুভূত হয়। ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের মাঝে স্থাপত্য অন্যতম।
সোমপুর বিহার, ময়নামতি, মহাস্থানগড় ইত্যাদি বাংলার স্থাপত্যের অন্যতম উদাহরণ। এগুলোর মাধ্যমে অতীত সমাজের শিল্পগুণ, সৃজনশীলতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
৬. জীবাশ্ম : জীবাশ্ম বলতে প্রাণী বা উদ্ভিদ পাথরে পরিণত হয়েছে এমন বন্ধুকে বুঝায়। এটি ইতিহাসের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের উদ্ভিদ ও প্রাণীর ধ্বংসাবাশেষ কিংবা মৃতদেহের চিহ্নের সন্ধান ভূ-গর্ভ কিংবা ভূপৃষ্ঠের কঠিন আবরণ থেকে সংরক্ষিত পাললিক শিলা অথবা যৌগিক পদার্থে মিশ্রিত অবস্থায় দেখা যায়।
ইতিমধ্যেই অধিকাংশ জীবিত প্রাণিকূলেরই জীবাশ্ম সংগৃহীত হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে বহু প্রাচীন আমলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
৭. চিত্রকলা : ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মাঝে অন্যতম হলো চিত্রকলা বা চিত্রশিল্প। বাংলায় প্রাচীনতম চিত্রকলার নিদর্শন হলো পাল আমলে রাজা মহিপালদেবের সময়ে তালপাতায় অঙ্কিত নালন্দা মহাবিহারের বৌদ্ধ অনুচিত্র।
বঙ্গীয় আমলে মানব সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার "পাণ্ডুবাজার ডিবি" -তে প্রাচীন যুগের মানুষের চিত্রাঙ্কন।
সর্বপ্রাচীন নিদর্শন পাণ্ডুবাজার ডিবিতে পাওয়া মৃপাত্রের গায়ে আঁকা নানা নক্সাধর্মী অলংকার। এসব চিত্রশিল্পের মাধ্যমে আদি যুগের মানুষের কৃষ্টি, কালচার, চিন্তা- চেতনা ইত্যাদি ধারণা পাই।
৮. ভাস্কর্য : ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলা হয়। বাংলা অঞ্চলে শিল্পের সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা কঠিন। যদিও নিম্ন গাঙ্গেয় বাংলা বা দক্ষিণ বাংলা কমপক্ষে খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতক থেকে পোড়ামাটির শিল্পের সবচেয়ে পরিচিত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।
প্রাথমিক পর্যায় থেকে বঙ্গীয় শিল্পকলা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় বিকশিত শিল্পেরই একটি পরিবর্ধিত ধারা হিসেবে প্রতীয়মান। ভাস্কর্য শিল্পের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা নিম্নরূপ-
(ক) কাঠ ও হাড়ের ভাস্কর্য : কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত বেশির ভাগ খোদাই শিল্পই ভেঙে বা ক্ষয়ে গেছে। সেগুলোর মাঝে ৬টি কাঠের এবং ৪টি হাড়ের তৈরি মূর্তি।
হাড়ের তৈরি মূর্তির নমুনাগুলো ভাস্কর্যের গুরুত্ব বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে যে, এগুলোতে মূর্তি ও বিলনি একই সাথে বিদ্যমান। যা বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের অন্যতম উপাদান।
(খ) আদি প্রস্তর ভাস্কর্য : আদি প্রস্তর ভাস্কর্য এখন পর্যন্ত বাংলায় আবিষ্কৃত এবং খ্রিষ্টীয় প্রথম তিন শতকে নির্মিত প্রস্তর ভাস্কর্যের খুব কমই সন্ধান পাওয়া যায়।
সাধারণ রীতির এই ভাস্কর্যগুলো উত্তর ভারতের শিল্পজগতে কুষাণদের উন্নত ধারার অন্তর্গত বলে মনে করা হয়। এই শিল্পের কেন্দ্র ছিল মথুরা।
এখানে সে সময়ে ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও জৈন মূলত এই তিনটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা পূজার নিমিত্তে মূর্তি বানাতে গিয়ে এই ধারার সূচনা করেছিল। বাংলায় প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন ২টি নমুনা লাল বেলেপাথরে নির্মিত এবং এতে কুষাণ রীতির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
(গ) গুপ্ত ভাস্কর্য : ভারতীয় উপমহাদেশের মূর্তির ইতিহাসে গুপ্ত যুগকে (আনুমানিক ৩০০-৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) উপেক্ষা করা কঠিন। ভারতীয় ভাস্কর্যের শিল্প বিবেচনায় এই অধ্যায়টি ছিল শিল্পযুগের সর্বোচ্চ চূড়া।
এ যুগে আবিষ্কৃত বেশ কিছু মূর্তির শৈলিগত দিক বিবেচনা করলে এ অঞ্চলে কমপক্ষে চার-পাঁচ শতক থেকে এ শিল্পের একটি ধারাবাহিক বিকাশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যটি বিহারের ভাগলপুরের শাকুণ্ড থেকে আবিষ্কৃত নরসিংহ মূর্তি ।
উপসংহার : আলোচনার শেষ পর্যায়ে এ কথা বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে ঐতিহাসিকদের অন্যতম সহায়ক উৎস হলো প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস।
মুদ্রা, লিপি, ভাস্কর্য, স্থাপত্য চিত্রের ধ্বংসাবশেষ, শিলালেখ, তাম্রশাসন ইত্যাদি প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম উপাদান। এ সকল উপাদানের সাহায্যে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানা সহজ হয়।
কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে তথ্যের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই প্রাচীন বাংলার জনপদ ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ইতিহাসে উল্লিখিত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।