ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি বর্ণনা কর
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি বর্ণনা কর |
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পটভূমি বর্ণনা কর
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ধনসম্পদ ও যুগে বিদেশি পর্যটক ও বণিকদের দৃষ্টি তাদের কেউ কেউ পর্যটনের উদ্দেশ্যে, উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন। অন্যান্য ইংরেজরাও ভারতবর্ষ তথা বাংলায় আগমন করেছিল এরূপ উদ্দেশ্য সাধনে।
সে সময় তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ব্যবসা- বাণিজ্য করে লাভবান হওয়া। কিন্তু কালক্রমে এবং পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতিতে তাদের উদ্দেশ্যের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার অভিলাষ ব্যক্ত করে। ফলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টা দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানি বাংলায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। এবং কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
→ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস : বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। প্রথমে বাণিজ্যিক সূত্র ধরে আগমন এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে কোম্পানি এদেশে আধিপত্য বিস্তার করে। নিম্নে বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস আলোচনা করা হলো-
১. ইংরেজদের ভারতবর্ষে আগমন : ভারতবর্ষে প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজদের। তারই ধারাবাহিকতায় ইংরেজরাও ভারতবর্ষে আগমন করে।
১৬০০ সালে ২১৮ জন ইংরেজ বণিক নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের নিকট থেকে ১৫ বছরের সনদ নিয়ে ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আসে।
রানি স্বয়ং এই কোম্পানির একজন অংশীদার হন। একজন শাসনকর্তা ও ২৪ জন সদস্য নিয়ে কোম্পানির কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়।
২. বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ : ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে কুঠি স্থাপনের লক্ষ্যে ক্যাপ্টেন হকিন্স রাজা প্রথম জেমসের একটি সুপারিশ পত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন।
কিন্তু ভারতীয় বণিক সম্প্রদায় ও পর্তুগিজদের বিরোধিতার কারণে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটি জাহাজ ক্যাপ্টেন বেস্টের নেতৃত্বে পর্তুগিজ নৌবহর বিধ্বস্ত করে সুরাট বন্দরে অবস্থান গ্রহণ করে।
ক্যাপ্টেন বেস্টের সাফল্যে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ সালে এক ফরমান দ্বারা সুরাটে ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।
৩. বাংলায় ইংরেজ আধিপত্য : ১৬৫১ সালে বঙ্গদেশের সুবাদার শাহ সুজা বাৎসরিক ৩,০০০ টাকা শুল্ক প্রদানের বিনিময়ে ইংরেজদের এদেশে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ প্রদান করেন।
১৬৭২ সালে আওরঙ্গজেব কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার গভর্নর শায়েস্তা খান ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন।
১৬৯০ সালে জব চার্নক ভাগীরথী নদীর তীে কালিকট, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম খরিদ করে কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়া তারা গোলকুণ্ডার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র মসলিমপট্টম, পুলিটোর নিকটবর্তী আরামগাঁও, হরিহরপুর, কাসিম বাজার, পাটনা, রাজমহল ও মালদহ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এভাবে ইংরেজগণ ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করে।
৪. সংযুক্ত কোম্পানি গঠন : ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এরূপ বাণিজ্যিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৬৯৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে অপর একটি কোম্পানি গঠন করে।
স্যার উইলিয়াম মরিসের নেতৃত্বে নতুন কোম্পানি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নতুন এবং পুরাতন কোম্পানি একত্রিত The Joint company of Merchants of England Trading to the East Indies' নামে সংযুক্ত কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং ১৭০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে। ফলে আধিপত্য বিস্তারের পথ আরো প্রশস্ত হয়।
৫. মুঘল আমলে ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার : কোম্পানির কর্মচারীদের অন্যায়ভাবে বাণিজ্য করার অভিযোগে গোলযোগ দেখা দেয়। এ অবস্থায় ১৬৮৬ সালে হুগলী আক্রমণ করলে মুঘল ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ আরম্ভ হয়।
শায়েস্তা খান তার আওতাভুক্ত সমস্ত ইংরেজ কুঠি দখল করে ইংরেজদের হুগলী থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু ইংরেজ কর্মচারী জব চার্নকের বদৌলতে তারা সুতানটি নামক স্থানে ফিরে আসেন।
এক বছর পর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথ একটি নৌবহরসহ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে ইঙ্গ-মুঘল সংঘর্ষ নতুন করে শুরু হয়।
সংঘর্ষে হিল পরাজিত হয়। ফলে ইংরেজদের সাথে মুঘলদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অবশেষে মুম্বাইয়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে ইংরেজরা পুনরায় বাণিজ্য করার অধিকার ফিরে পায়।
৬. ফররুখশিয়ারের ফরমান লাভ : ১৭১৩ সালে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে বাহাদুর শাহের পৌত্র ফররুখশিয়ার দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে। ১৭১৪ সালে কলকাতা থেকে জন সারম্যান নামে জনৈক ইংরেজ দূত বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট ফররুখশিয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
ইংরেজদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে মুঘল সম্রাট ১৭১৭ সালের এক ফরমান দ্বারা বাংলা, মাদ্রাজ ও মুম্বাইয়ে বিনাতকে বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন।
ইংরেজরা বাৎসরিক মাত্র ৩,০০০ টাকা খারানা প্রদানের অঙ্গীকারে বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকার পায়।
মুর্শিদাবাদ টাকশালে কোম্পানি তার নিজস্ব টাকা তৈরি করার অনুমতি পায়। ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়।
৭. পলাশির যুদ্ধ : আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব নিযুক্ত হন। কিন্তু সিরাজের সিংহাসনে আরোহণ তার আত্মীয়স্বজনদের অনেকে মেনে নিতে পারেনি।
তাই নবাবের খালা ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। তাদের সাথে যুক্ত হয় ইংরেজ কোম্পানি।
তারা নবাবের আদেশ অমান্য করে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নবাব সিরাজ ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণের বিরোধিতা করে। ফরাসিরা নবাবের আদেশ মান্য করলেও ইংরেজরা তা প্রত্যাখ্যান করে।
তাছাড়া ইংরেজ কোম্পানি নানাভাবে নবাবের আদেশ নিষেধ অমান্য করতে থাকে। এসব ঘটনা থেকে নবাব উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজদের শায়েস্তা করা জরুরি।
তাই তিনি কাসিম বাজার বাণিজ্য কুঠি আক্রমণ করে। দখল করে নেন। ফলে কোম্পানিও এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আবার কলকাতা পুনরুদ্ধার করে।
নবাব কলকাতার পরাজয়ের গ্লানি দূর করার জন্য আলিনগরের সন্ধি করেন। অন্যদিকে ইংরেজরা নবাবকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার পন্থা খুঁজতে থাকে।
যার ফলশ্রুতিতে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শিকার নবাব পরাজিত হয়। ফলে বাংলায় কোম্পানির শাসনের পথ আরো প্রশস্ত হয়।
৮. বক্সারের যুদ্ধ : পলাশির যুদ্ধ ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের প্রাথমিক ভিত্তি দিলেও তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে। পলাশির পর বাংলার নবাব হন মীর জাফর।
তিনি ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বটে তবে তার পক্ষে ইংরেজদের চাহিদা মেটানো সম্ভবপর হচ্ছিল না। তাই ইংরেজরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে মীর কাসিমকে বাংলার সিংহাসনে বসায়।
মীর কাসিম ছিলেন স্বাধীনচেতা নবাব। তিনি কোম্পানির প্রাধান্য খর্ব করার জন্য চেষ্টা করেন। ফলে অচিরেই কোম্পানির সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়।
এ বিরোধের জের ধরে ১৭৬৪ সালে ইংরেজ কোম্পানি ও মীর কাসিমের মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মীর কাসিম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে বাংলায় ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।
৯. কোম্পানির দেওয়ানি লাভ : পলাশির যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনকে স্বীকার করে অসহায় দিল্লির সম্রাট কয়েকবার কোম্পানির বাৎসরিক কিছু উপঢৌকনের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
কিন্তু কোম্পানি নানা কারণে সম্রাটের সেসব অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, এই অবস্থায় কোম্পানির সামনে দেওয়ানি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।
অবশেষে ক্লাইভ দেওয়ানি গ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এলাহাবাদে অবস্থানরত সম্রাট শাহ আলমের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে প্রচুর উপঢৌকন দেন।
সম্রাটের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তিনি কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রদানের জন্য প্রস্তাব করেন।
সম্রাট বিনা “দ্বিধায় ক্লাইভের প্রস্তাবে রাজি হন এবং ১৭৬৫ সালের এক চুক্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদ অর্থাৎ রাজস্ব শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাতে অর্পণ করেন। ফলে সত্যিকার অর্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় ।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় আধিপত্য বিস্তার বাংলার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক নীতির জন্য কোম্পানি তথা ইংরেজরা বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত করে।
বাণিজ্য করার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন কলাকৌশলে বাংলায় সাম্রাজ্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। মূলত ১৬৩৩ সালে কোম্পানির আধিপত্যবাদী তৎপরতা শুরু হয় আর তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে।
মোটকথা, কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাণিজ্য করার সুযোগ নিয়ে তারা ধীরে ধীরে এদেশে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে এবং অবশেষে এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা করে।