চর্যাগীতি কি । চর্যাগীতি পরিচয় দাও
চর্যাগীতি কি । চর্যাগীতি পরিচয় দাও |
চর্যাগীতি কি । চর্যাগীতি পরিচয় দাও
- অথবা, চর্যাগীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলা ভাষার প্রাচীন বা আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ বা চর্যাগীতি। এর আগে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
চর্যাগীতি নব্য ভারতীয় আর্যভাষার পূর্বাঞ্চলীয় উপশাখার অন্তর্গত বাংলা-অহমিয়া ভাষাগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচিত।
এটি প্রাচীন যুগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং ভাষার লিখিত নিদর্শনের ইতিহাসের সীমা কয়েকশত বছর বাড়িয়ে দিয়েছে।
১. চর্যাগীতির পরিচয় : চর্যাগীতি মূলত ধর্মীয় ভাবসমৃদ্ধ কাব্য সংকলন, বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন পদ্ধতিমূলক গান বা গীতি কবিতা। এরা বৌদ্ধ বিহারগুলোর মাধ্যমে এগুলোর চর্চা করতেন।
চর্যাগীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে 'সন্ধ্যা' ভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্ম সাধনার কথা প্রচার করা। চর্যাপদ তাই প্রচারধর্মী। সজ্ঞানে কাব্যরস সৃষ্টির কোনো চেষ্টা এতে নেই ।
২. চর্যাগীতির আবিষ্কার : বাংলায় এগারো শতকে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং হিন্দু সেন বংশের শাসন শুরু হয় । ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশেষ ধনী বৌদ্ধ সাধকরা পুঁথি নিয়ে চলে যায় উত্তরে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে।
বাংলার বিখ্যাত পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পুঁথি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বার বার নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৮৯৭ সালে প্রথম এবং ১৮৯৮ সালে দ্বিতীয় নেপাল ভ্রমণের সময় তিনি কিছু বৌদ্ধধর্মীয় পুঁথিপত্র সংগ্রহ করেন।
১৯০৭ সালে তৃতীয় অনুসন্ধান ভ্রমণের সময় নেপালের রাজ গ্রন্থাগার থেকে কতকগুলো নতুন পুঁথির সন্ধান পান, এগুলোই চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। এই চর্যাপদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।
৩. চর্যাপদের ভাষা : চর্যাগীতি যখন রচিত হয় তখন বাংলা ভাষা পুরোপুরি স্বতন্ত্র ভাষা হয়ে উঠেনি। কেবল কিছু আগে বাংলা ভাষা থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র হয় উড়িয়া ভাষা, তখনো মৈথিলি আর অসমিয়া বাংলা থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হয়ে উঠেনি।
ফলে চর্যাপদের ভাষায় এইসব ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। চর্যাপদের পদগুলোর ৫টি ভাষার মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয় বাংলা, হিন্দি, মৈথিলী, অসমীয়া ও উড়িয়া। এটি পশ্চিম বাংলার প্রাচীন কথা ভাষায় লিখিত।
কার্যকরভাবে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া উড়িয়া বা অসমীয়া ভাষার কেউ বিশ্বাস করে না যে, চর্যাপদের ভাষা বাংলা চর্যাগীতির ভাষা বাংলা নয়, এ নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন বিজয়চন্দ্র মজুমদার ১৯২০ সালে। ড. সুনীতি কুমার বলেন, চর্যাপদের ভাষা বাংলা কিন্তু ড. শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের ভাষা বঙ্গকামরূপী।
৪. চর্যাগীতি রচনাকাল : পাল আমলে চর্যাপদের পদগুলো লিখিত হতে শুরু করে। সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীকাল জুড়ে এগুলো লিখিত হয়। তবে এর রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতমহলে দ্বিমত রয়েছে।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, চর্যাপদের রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী (১৫০-১২০০) খ্রিস্টাব্দ।
রাহুল সাংস্কৃতায়ন এবং আরো অনেক পণ্ডিত এ মত মেনে নেননি। ড. শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাগীতির রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী (৬৫০-১২০০) খ্রিষ্টাব্দ।
৫. চর্যাপদের কবিতা : চর্যাপদ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লিখিত হয়নি। মূলত বৌদ্ধ সহজযানপন্থি সহজিয়াগণ তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য গান হিসেবে এই পদগুলো রচনা করেন।
সুকুমার সেনের মতে, চর্যাপদের মোট গানের সংখ্যা ৫১টি এর মধ্যে পাওয়া গেছে ৪৬টি। ২৪, ২৫, ৪৮ নং এবং ২৩ নং এর অর্ধেক পদ পাওয়া যায়নি। ১১নং পদকে প্রাপ্তি তালিকায় গণ্য করা হয়নি।
৬. চর্যাগীতির ছন্দ : চর্যাগীতি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদের ছন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারও মতে, চর্যাপদ চার মাত্রার চারভিত্তিক যোল মাত্রার পানাকুলক ছন্দ, কারও মতে পজঝটিকা ছন্দ।
কারও মতে, অপভ্রংশ অবহটঠ রচনায় ছন্দের অনুকরণ, কেউবা পদ্মার ত্রিপদী তথা অক্ষয় বৃত্তের প্রবণতা লক্ষ করেছেন।
৭. চর্যাগীতির কবিগণ : চর্যাগীতির রচয়িতা মোট ২৪ জন কৰি পদকর্তাদের নামের শেষে গৌরবসূচক পা যোগ হয়েছে। চর্যাপদের কবিগণ হলেন- কাহ্নপা, ভুসুকুপা, সরহপা, কুক্কুরীপা, লুইপা, কাচরপা, শান্তিপা, উল্লেখযোগ্য বা বেশি পদরচনা করেছেন।
এছাড়া বিরূপা, অন্তরীপা, ফাটিল্লপা, কমলারপা, ভোধীকা মহিধরপা, বীনাপা, তন্ত্রীপা, আজদেবপা, চেন্তনপা, দারিকপা, ভাদেপা, তাড়কপা, কম্বলপা জয় নন্দিপা, ধর্মপা ১টি করে পদ রচনা করেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, চর্যাগীতি শুধু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন নয় এবং প্রাচীন বাংলা গানেরও আদি নিদর্শন নয়, বরং এটি উন্নতমানের এবং অর্থবাহী রচনাশৈলী।
এর ভাষাকে সম্পাদক নিজেই আলো আধারীর ভাষা বলে অভিহিত করেছেন, যেটা রচিত হয়েছিল ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে।
সর্বোপরি চর্যাগীতি বা চর্যাপদ সাহিত্যিক তত্ত্ববৃিতিতে সমসাময়িক সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার | প্রতি শ্রদ্ধা এবং বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতার জলদায়ক।