বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল আলোচনা কর
বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল আলোচনা কর |
বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল আলোচনা কর
- অথবা, বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকালের বিবরণ দাও।
উত্তর : ভূমিকা : ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবী বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর শাজার-উদ-দার মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠা করে। এ মামলুকরা ছিলেন ২ ভাগে বিভক্ত।
বুরুজি মামলুক বংশ তাদের মধ্যে একটি বাহারি মামলুকদের রাজত্বের শেষ সময়ে বুরুজী মামলুকগণ ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেন।
বাহারি মামলুক সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৩৮২ সালে সাইফুদ্দিন বারকুক বাংরিসুলতান আল সাপিহ হাজীকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইতিহাসে বুরুজী মামলুক বংশ নামে পরিচিতি। এ বংশের ২৩ জন শাসক সর্বমোট ১৩৫ বছর রাজত্ব করেন।
→ বুরুজী মামলুকদের পরিচয় : বাহারি মামলুক সুলতান কালাউন তার সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব প্রদান করার জন্য এবং মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এক শ্রেণির ক্রীতদাস ক্রয় করেন।
এবং তাদেরকে দেহরক্ষী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ প্রদান করেন। সুলতান কালাউন এদের বুরুজি অর্থাৎ দুর্গের সুইচ্চ গম্বুজ প্রকোষ্ঠে বসবাসের ব্যবস্থা করেন বিধায়, তাদের বুরুজি মামলুক বলা হয়।
বুরুজি মামলুকরা ১৩৮২-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিল। এ বংশের মোট ২৩ জন শাসক ছিলেন। প্রথম হলেন সুলতান বারকুক।
বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল : বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল বা শাসনকাল আলোচনা করার পূর্বে এদের পরিচয় জানা প্রয়োজন
১. সুলতান বারকুক (১৩৮২-১৩৯৯) : বুরুজী মামলুকদের প্রথম সুলতান বারকুক আল জাহির প্রথম জীবনে একজন ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ১৩৬৭ সালে বাহারি সুলতান আল ২য় শাবানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে অল্পদিনের মধ্যে সেনাপতি পদ লাভ করেন।
অতঃপর তিনি বাহারি মামলুকদের সর্বশেষ সুলতান হাজী আল-সালিহকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ক্ষমতাগ্রহণের পর সিরিয়ার বিদ্রোহ দেখা দেয়।
তিনি এ বিদ্রোহ দমনে চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। অতঃপর সিরিয়ার বিদ্রোহ বা কায়রো দখল করে বারকুককে পরাজিত করেন।
এই পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। অতঃপর তিনি বিশাল সৈন্য নিয়ে সিরিয়া আক্রমণ করে পুনরায় মিশরের সিংহাসন দখল করেন।
২. ফারাজ আল নাসির (১৩৯৯-১৪০৫) : সুলতান বারকুককের মৃত্যুর পর তার পুত্র ফারাজ ১৩৯৯ সালে মিশরের সিংহাসনে বসেন। তিনি যখন সিংহাসনের আরোহণ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।
সুলতান ফারাজ নাবালক হওয়ার কারণে সিরিয়া ও দামেস্কোর আমীরগণ সুলতানের অধীনতা অস্বীকার করেন। তিনি ১৪০১ সালে নিজেই যুদ্ধ পরিচালনা করে সিরিয়া ও দামেস্কোর বিদ্রোহ দমন করে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
৩. সুলতান আল মুয়াইয়াদ শাইৰ (১৪১২-২১) : বিদ্রোহী আমির শেখ মুয়াইয়াদ ১৪১২ সালে সুলতান ফারাজকে নিহত করে দামেস্কোতে এক সভা আহবান করে আল আনিলকে মিশরের খলিফা ঘোষণা করেন।
এরপর মাত্র ৬ বছর পর শেখ মুয়াইয়াদ সকল ক্ষমতা হস্তগত করে মুস্তাসিন আল-আদিলকে | পরাজিত করে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন।
তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন। শেখ মুয়াইয়াদ নিজের পথ পরিষ্কার করতে শত্রু নিধন ছাড়াও প্রভাবশালী আমীরদের দমন করেন।
৪. সাইফ উদ্দিন বার্সবে আল আশরাফ (১৪২২-১৪৩৮) : সুলতান সাইফুদ্দিন বার্সবে ১৪২২ সালে বুরুজী মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি প্রথম জীবনে বারকুকের অধীনে একজন ক্রীতদাস ছিলেন।
বার্সবে নিজ যোগ্যতা বলে ত্রিপলির গভর্নর নিযুক্ত হন। অতঃপর তিনি সুলতান নাসির উদ্দিন মুহাম্মাদ আস | সালিহ এর অভিভাবক নিযুক্ত হন।
এরপর অতঃপর তিনি সুলতান নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ আস সালিহ এর অভিভাবক নিযুক্ত হন। এরপর অভিভায় সময়ের মধ্যে সুলতান মুহাম্মদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করেন।
তিনি সিংহাসন দখল করার পর লিবিয়ার ত্রিপলিতে ও দামেক্ষেতে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দিলে সকল বিদ্রোহ অত্যন্ত সফলতার সাথে দমন করেন।
৫. জালালউদ্দিন ইউসুফ (১৪৩৮) : ১৪৩৮ সালে সুলতান | সাইফউদ্দিন বার্সবের মারা যাওয়ার পর তার পুত্র জালাল উদ্দিন [ ইউসুফ পিতার মনোনয়ন অনুসারে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মাত্র কয়েক মাস ক্ষমতায় ছিলেন।
৬. সাইফুদ্দিন জামার্ক (১৪৩৮-১৪৫৩) : সেনাপতি কারকমাশ এর সহযোগিতায় সাইফুদ্দিন জাকমার্ক সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তাদের মধ্যে মনোমালিণ্য হলে সুলতান তাকে পরাজিত ও নিহত করেন।
৭. আল মনসুর (১৪৫৩) : সুলতার জকমার্কের মৃত্যুর পর ১৪৫৩ সালে ফখরউদ্দিন উসমান আল মনসুর সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তার নিষ্ঠুরতার জন্য কয়েক মাসের মধ্যে তিনি সিংহাসনচ্যুত হন।
৮. সাইফ উদ্দিন আল আশরাফ (১৪৫৩-১৪৬৯) : আল মনসুরের পর আল আশরাফ কায়রোর সিংহাসনে আরোহন করেন। সুলতান আল আশরাফ দুর্বল শাসক ছিলেন এজন্য সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করত।
৯. সুলতান সারফুদ্দিন কায়েত-বে (১৪৬৮-১৪৯৫) : সুলতান কায়েত-রে ১৪৬৮ সালে বুরুজী মামলুক সিংহাসনে বসেন। তিনি বুরুজী মামলুক সুলতানদের মধ্যে তার শাসনকাল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও গৌরবোজ্জ্বল।
তিনি সিবার মামলুক বাহিনীকে পরাজিত করলে কয়েতবে তা সহজে মেনে নিতে পারে নি। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কূটনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সিবার মৃত্যুবরণ করলে সুলতান কায়েত-রে প্রাথমিক বিপদ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুলমান ছিলেন।
মক্কাসহ ইসলামের পবিত্র স্থানসমূহ সংস্কারের জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। কায়েত-বে দীর্ঘ ২৭ বছর রাজত্ব করার পর ১৪৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
১০. সুলতান কানসহ আল-ঘুরী আল-আশরাফ (১৫০১-১৫১৬) : মিশরের বুরুজী মামলুকদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং শ্রেষ্ঠ সুলতান কায়েত-বের মৃত্যুর পর তিনজন সুলতান কায়রোর সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এরা ছিলেন মুহাম্মাদ নাসির (১৪৯৬ - ১৪৯৮ খ্রি.) কানসহ আল জাহির (১৪৯৮-১৪৯৯ খ্রি.) এবং আল আশরাফ। তারা তিনজন পাঁচ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু এরা ছিল অযোগ্য ও অপদার্থ। এরপর কানসুহ আল ঘুরী মামলুক সিংহাসনে বসেন।
তিনি ৬০ বছর বয়স্ক সুলতান হলেও যৌবনের তেজ নিয়ে মিশরের শাসনভার গ্রহণ করেন। সিংহাসন লাভ করেই তিনি অল্পদিনের মধ্যে সাম্রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন ।
→ মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধ : বুরুজী মামলুক সুলতান কানসুহ আল ঘুরী পারস্যের শাহ ইসমাঈলকে সাহায্যে করার জন্য একদল সেনাবাহিনী নিয়ে তুর্কিদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য আলেপ্পোর সামান্য উত্তরে ‘মারজ-ই-দাবিক' নামক যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হয়।
বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে মামলুক বাহিনী তুর্কিদের নিকট পরাজয় বরণ করেন। সুলতান কানসহ আল ঘুরী পলায়নের সময় অশ্বারোহীর পদচাপে প্রাণ হারান। মারাজ-ই-দাবিকের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫১৬ সালের ২৪ আগস্ট।
এর পরবর্তী ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল তুমান বেকে হত্যা করে প্রথম সেলিম মিশরকে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করে। ফলে মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মিশরে বুরুজী মামলুকদের রাজত্বকাল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ বংশের অধিকাংশ শাসক অযোগ্য অপদার্থ ও দুর্বল ছিলেন।
এজন্য ১৫১৭ ফলে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের নিকট বুরজী মামলুকদের চুড়ান্ত পতন ঘটে। বুরুজী মামলুকদের শাসনকাল মিশর তথা ইসলামে ইতিহাসে স্বরণীয় হয়ে আছে। তারা শক্তিশালী শাসক না হলেও প্রায় ১৩৫ বছর মামলুক বংশকে টিকিয়ে রেখেছিল।