বৈদেশিক নীতির উল্লেখপূর্বক সুলতান কালাউনের শাসনকাল পর্যালোচনা কর
বৈদেশিক নীতির উল্লেখপূর্বক সুলতান কালাউনের শাসনকাল পর্যালোচনা কর |
বৈদেশিক নীতির উল্লেখপূর্বক সুলতান কালাউনের শাসনকাল পর্যালোচনা কর
- অথবা, জনহিতকর কার্যাবলির বিশেষ উল্লেখপূর্বক সুলতান কালাউনের রাজত্বকাল আলোচনা কর।
- অথবা, জনহিতকর কার্যাবলির বিশেষ উল্লেখপূর্বক কালাউনের শাসনামলের বর্ণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : ১২৫০ সালে মিশরে আইয়ুবী বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর মামলুক বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা অন্যতম আলোচিত ঘটনা। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১২৬০ সালে বাইবার্স মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তিনি ছিলেন মামলুক বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বাইবার্সের পুত্রদের মধ্য গৃহবিবাদ দেখা দেয়। ফলে মামলুক বংশকে রক্ষার জন্য এ সময় ক্ষমতায় আসেন সাইফুদ্দীন কালাউন।
তিনি অভ্যন্তরীণ ও বহিঃদেশীয় বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলির দ্বারা মামলুক শাসনের ভিত্তি মজবুত করেন।
প্রাথমিক পরিচয় : কালাউনের প্রকৃত নাম ছিল আল মালিক আল মনসুর সাইফুদ্দীন কালাউন আল আলফি। তিনি ১২২৩ সালে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর তীরবর্তী কিপচাক তুর্কি গোত্রের কুমান শাখায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাল্যকাল সিরিয়া ও দামেস্কে দাস হিসেবে অতিবাহিত হয়। দেখতে অতি সুদর্শন হওয়ায় বাল্যকালে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ তাকে ১,০০০ দিরহাম দিয়ে ক্রয় করে নিজ দেহরক্ষী বাহিনীতে নিযুক্ত করেন ।
সিংহাসনারোহণ : কালাউন সামান্য সৈনিক হিসেবে জীবন যুদ্ধ করলেও অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ মেধা, সাহস ও দূরদর্শিতার বলে তিনি প্রধান সেনাপতি উন্নতি লাভ করেন।
এদিকে শ্রেষ্ঠ মামলুক সুলতান বাইবার্স মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পুত্র সাঈদ আল বারকা সিংহাসনে বসেন। কালাউন তাঁর এক কন্যাকে সাঈদের সাথে বিয়ে দিয়ে কিছুটা ক্ষমতা লাভ করেন।
পরে সাঈদ তাঁর ভাই আল সালামিশ কর্তৃক পদচ্যুত হলে কালাউন সালামিশের অভিভাবক নিযুক্ত হন। কিন্তু লালামিশ ছিলেন অদক্ষ ও অযোগ্য।
তাই সুযোগ বুঝে কালাউন ১২৭৯ সালে সালামিশকে পদচ্যুত করে নিজে মালিক আল মানসুর সাইফুদ্দীন উপাধি নিয়ে মামলুক সিংহাসনে বসেন।
সুলতান কালাউনের শাসন বা রাজত্বকাল : মামলুক সুলতান কালাউনের জনহিতকর কার্যাবলির বিশেষ উল্লেখপূর্বক শাসনকাল বা রাজত্বকাল নিচে আলোচনা করা হলো।
(ক) কালাউনের বৈদেশিক নীত : সুলতান কালাউন ১২৭৯ সালে দুর্বল ও অযোগ্য সুলতান আল সালামিশকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এরপর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিদ্রোহ দমন করে তিনি বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তাঁর বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করেন। নিম্নে এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হলো।
১. মোঙ্গলদের দমন : ১২৭৯ সালে কালাউনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমনের সুযোগে মোগল অধিপতি আৰাগা এবং তাঁর ভাই মেধু খান আলেপ্পো শহর দখল করে নিয়েছিলেন।
ফলে মোঙ্গলদের দমনের জন্য কালাউন ১২৮০ সালে হিমসের প্রান্তরে মোঙ্গলদের সম্মুখীন হন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে মোঙ্গলগণ এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আলেপ্পো ত্যাগ করে চলে যায়।
২. আঙ্কার তুসের সাথে সন্ধি : সুলতান কালাউন মোঙ্গলদের, আলেপ্পো থেকে বিতাড়িত করার পর আস্তার তুসের টেম্পলারদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করেন। আড্ডার তুসের শাসকের সাথে কালাউনের ১০ বছরের জন্য শান্তি চুক্তি ঘোষিত হয়।
৩. সিংহল ও চীনের সাথে সম্পর্ক : এ সময় সুলতান কালাউন দক্ষিণ এশিয়ার সাথেও তাঁর সম্পর্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
ফলে এ সময় সিংহলের রাজা কালাউনের দরবারে একজন দূত পাঠালে তিনি তাঁকে রাজকীয় সম্বর্ধনা জানান। কালাউন তার শাসনামলে চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য একটি বাণিজ্য বহর প্রেরণ করেছিলেন।
৪. ভারতের সাথে সম্পর্ক : এ সময় ভারতেও আলাউদ্দিন খলজির নেতৃত্বে একটি মামলুক তথা দাস বংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।
ফলে কালাউন ভারতের সাথে তাঁর বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন, ফলে তাঁর উদ্যোগে এ সময় মিশরের একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল ভারতবর্ষে আগমণ করলে মামলুকদের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হয়।
৫. গোল্ডেন হোর্ডের মোঙ্গলদের সাথে সম্পর্ক : ১২৮০ সালে মোঙ্গলগণ আৰাগা খান ও মেনু খানের নেতৃত্বে আলেপ্পো শহর দখল করে নেয়।
পরে ১২৮০ সালের হিমসের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা বিতাড়িত হলে মোঙ্গলদের অপর অংশ তথা গোল্ডেন হোর্ডের মোঙ্গলদের সাথে সুলতান কালাউনের সম্পর্কের উন্নতি হয়।
ফলে গোল্ডেন হোর্ডের মোঙ্গল এবং বাইজান্টাইন সম্রাটের সাথে সুলতানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।
(খ) কালাউনের রাজত্বকাল/জনহিতকর কার্যাবলি : সুলতান সাইফুদ্দীন যদিও অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ১২৭৯ সালে মামলুক সিংহাসনে আরোহণ করেন তবুও তাঁর শাসনকাল মানাবিধ জনহিতকর কার্যাবলির জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। নিম্নে তাঁর কিছু জনহিতকর কার্যাবলি আলোচনা করা হলো।
১. কারা সুনকুরের বিদ্রোহ দমন : সুলতান বাইবার্সের মৃত্যুর পর সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা কারা সুনকুর বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করে।
পরে কালাউন এক অভিযান চালিয়ে তাকে বন্দি করেন এবং সে আনুগত্য স্বীকার করলে পুনরায় তাকে স্বপদে বহাল করেছিলেন।
২. মোঙ্গলদের দমন : কালাউনের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের সুযোগে মোঙ্গল নেতা আবাগা খান ও তাঁর ভ্রাতা মে খান আক্রমণ চালিয়ে সিরিয়ায় আলেপ্পো শহরটি দখল করে নেয়।
এবং মিশরের দিকে অভিযান চালান। ফলে ১২৮০ ফলে হিমসের প্রান্তরে মামলুক মোঙ্গলদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উক্ত যুদ্ধে মামলুকরা বিজয়ী হলে মোঙ্গলগণ বিতাড়িত হন।
৩. বাহারি মামলুকদের দমন : কালাউন ক্ষমতায় এসে মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। তিনি এদের একটি শক্তিশালী বুরুজ বা দুর্গে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ফলে অনেকে তাদের বুরুজি মামলুক বলে ডাকত।
এদের সংখ্যা ছিল ১২,০০০ এর মতো। এদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বাহারি মামলুকরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করলে সুলতান বাহারিদের কিছু সংখ্যককে কারারুদ্ধ ও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন।
৪. ক্রুসেডারদের দমন : কালাউনের মোঙ্গল বিরোধী অভিযানের সুযোগে মার্কারের হস্পিটালারের নাইটগণ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে অভিযান চালিয়ে লুটপাট চালায়।
কালাউন অভিযান চালিয়ে ১০ বছরের জন্য তাদের সাথে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। তাছাড়া টর্টোসার টেম্পলার এবং ত্রিপোলিসের প্রিন্স ও অনুরূপ সন্ধি স্বাক্ষর করেন।
৫. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা : সুলতান কালাউন ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াবলি গণোর জন্য সর্বপ্রথম ও মাজহাবের জন্য ৪ জন ইমাম নিয়োগ দেন।
তাঁর সময়ে রাজ্যে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান ও আবুল ফিদা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
৬. ডাক ব্যবস্থার উন্নয়ন : সুলতান কালাউন ডাক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ডাক বহনের জন্য সেনাবাহিনীর কিছু লোককে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর সময়ে কায়রো থেকে দামাস্কাসে একটি ডাক যেতে সময় লাগত ৬০ ঘণ্টা।
৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : কালাউন প্রজাসাধারণের কল্যাণে রাজ্যে অসংখ্য রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং রাস্তার দু'ধারে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলেন।
পথচারীদের সুবিধার জন্য প্রতি দু'মাইল অন্তর অন্তর সরাইখানা নির্মাণ করেন এবং রাত্রিবেলায় নৈশপ্রহরীর ব্যবস্থা করেন।
৮. আল মারিস্তান আল মানসুরি : সুলতান কালাউন ছিলেন স্থাপত্য শিল্পের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। আল মারিস্তান আল মানসুরি তাঁর স্থাপত্যকীর্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান একাধারে হাসপাতাল, বিদ্যানিকেতন, মসজিদ ও সমাধিসৌধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৯. জেনোয়ার সাথে মৈত্রী : সুলতান কালাউন নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য ও মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করতেন।
মামলুক সুলতান কালাউনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অরঘুরের রাজা রোমের পোপ ও ফ্রান্সের সম্রাটের সাথে মৈত্রী গঠন করে। কালাউন মৈত্রী জোটের মোকাবিলায় জেনোয়ার সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন ।
১০. পরধর্মসহিষ্ণু : সুলতান সাইফুদ্দীন কালাউন ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের আচার-বিধি যথাযথভাবে পালন করলেও তিনি অন্যের ধর্মের প্রতি ছিলেন সহনশীল। ফলে তাঁর রাজত্বকালে বিধর্মীদের কোনো প্রকার নিগ্রহের শিকার হতে হয়নি ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মামলুক শাসনের দুর্দিনে সাইফুদ্দীন কালাউন ক্ষমতায় এসে একে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।
একদিকে মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের হামলা প্রতিহতকরণ অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে তিনি রাজ্যের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন বিভিন্ন জনহিতকর কার্যাবলির মধ্য দিয়ে নিজেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলুক সুলতান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মুসলিম শাসনের স্থায়িত্ব বিধানে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।