বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ নদীর প্রভাব আলোচনা কর
বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ নদীর প্রভাব আলোচনা কর |
বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ নদীর প্রভাব আলোচনা কর
- অথবা, প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে নদ-নদীর প্রভাব আলোচনা কর।
- অথবা, প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ-নদীর প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, মহানন্দা এবং তাদের অসংখ্যা শাখা প্রশাখা যুগযুগ ধরে প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
নদীগুলো ছিল বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রাণসরূপ । এ নদ-নদীগুলোই এদেশের অসংখ্য জনকীর্ণ শহর ও গ্রামের উত্থান-পতনের জন্য দায়ী।
→ বাংলার নদ-নদী : বাংলা পৃথীবীর অন্যতম বৃহৎ নল নদীসমূহের সম্মিতি ধৌত। আবুল ফজল বলছেন, বাংলার নদ-নদী অসংখ্য।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পরা, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, কুশিয়ারা, মহানন্দা ইত্যাদি নদ-নদী এবং এদের শাখা-প্রশাখা এদেশে বুকে বয়ে যাচ্ছে।
প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ-নদীর প্রভাব : বাংলার প্রান্তসীমায় সামান্য পাহাড় পর্বত ছাড়া মূল ভূ-খণ্ডের অধিকাংশ অঞ্চলই সমভূমি।
ফলে অসংখ্য নদ-নদী ছড়িয়ে আছে এ দেশের বুকে। নিচে প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ- নদীর প্রভাব আলোচনা করা হলোঃ
১. মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশে বর্ষাকাল ছয়মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বর্ষাকালে অধিকাংশ নদীই দুকুল ছাড়িয়ে প্লাবিত হয়। এবং বর্ষাকালে বাংলার সমতলভূমি বর্ষার পানিতে তলিয়ে যায়।
ব্যাকালে নদীগুলো প্রচুর পলিমাটি বয়ে আনে। ফলে বাংলার মাটি হয়ে ওঠে উর্বর। উর্বর মাটিতে প্রচুর ফসল ফলে বাংলার মাটি হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা।
২. যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম : প্রাচীনকাল থেকেই নদনদীগুলো হলো যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। তাই নৌকা নির্মাণ-নৌকা চলনায় এদেশের মানুষ হয়ে ওঠে দক্ষ।
তাছাড়া নদ-নদী ও পানি দ্বারা পরিবেচিত থাকায় বাংলার অধিবাসীরা নদীপথে পণ্য পরিবহণ করে অত্যন্ত সহজভাবে। তাই নদীগুলো হলো পর্ণ পরিবহণ ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম।
৩. সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব : নৌকার একটি বড় প্রভাব রয়েছে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে। বিশাল আকাশ আর তার নিচে বয়ে চলা নদীর উপরে বৈঠা বাইতে গিয়ে মাঝির কণ্ঠ থেকে বেরোয় মধুর সুর। এভাবেই গীত হয় এদেশের ভাটিয়ালি আর সারি গান।
৪. বাংলায় নৌবহর প্রতিষ্ঠা : বাংলায় অসংখ্য নদ-নদী থাকায় বাংলার অধিবাসীরা মৌ চালনায় ও নৌকা নির্মাণে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বিদেশি আক্রমণের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য নৌযুদ্ধে পারদর্শী হয়ে একটি শক্তিশালী নৌবহর প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা।
৫. অর্থনৈতিক জীবনে প্রভাব : বাংলার নদ-নদীগুলো দেশ ও দেশের বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে।
নদীপথে মানুষ ও পণ্য যাতায়াত করে থাকে যা আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ।
এ নদ-নদীগুলো কৃষিকাজের জন্য প্রাচীন বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন বাংলার বহু মানুষ জীবকা নির্বাহ করতো নদীতে মাছ ধরে। সুতরাং বলা যায় প্রাচীন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নদী ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
৬. খাদ্য ও বাসস্থানের উপর প্রভাব : ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই বাংলার অধিবাসীদের খাদ্য ও বাসস্থানের স্বরূপ নির্ধারণ করেছে।
নদ-নদী ও খালবিলের মাধ্যমে জলসেচের কারণে বাংলায় জন্মায় প্রচুর ধান আর নদ-নদীতে হয় প্রচুর মাছ। তাই বাংলার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভাত আর মাছ
৭. প্রাকৃতিক উত্থান-পতন : নদ-নদীর ফলে বাংলায় যেমন অসংখ্য নগর-বন্দর গড়ে ওঠেছে আবার নদী ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, বহু সমৃদ্ধ নগর ও বন্দর রাজধানী, রাজ্যপাট প্রভৃতি। তাইতো একটি মুর্শিদী গানে নদী ভাঙনের এ ভায়াল চিত্রটি ফুটে ওঠেছে।
‘একুল ভাঙে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা সকাল বেলা আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা এইতো নদীর খেলা'।
৮. শ্রমের উপর প্রভাব : বাংলার জনগণ একধারে জনবিমুখ সংগ্রামশীল। এখানে অনায়াসে প্রচুর খাদ্যশস্য ও মাছ উৎপাদিত হয় বলে বাংলার জনগণ হয়ে উঠে কর্মবিমুখ।
পক্ষান্তরে বর্ষাকালে, বন্যা, ঝড়ঝঞ্ঝা ও নদীর ভাঙা-গড়ার সাথে লড়াই করে মানুষকে বাঁচতে হয় বলে প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা ছিল সংগ্রামশীল ।
৯. ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর প্রভাব : বাংলার নদীপথের যাতায়াত সহজ ও সুলভ ছিল। এ কারণে এদেশে যে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার হয়েছিল এবং শিল্পজাত দ্রব্য বৃদ্ধি পেয়েছিল।
নদীপথে এদেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে সমুদ্র যাতায়াত সম্ভব ছিল বিধায় ব্যাপক রপ্তানি বাণিজ্য সৃষ্টি করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের উপর নদ-নদীর প্রভাব অপরিসীম।
এ নদ- নদীগুলো বাংলাকে করেছে প্রাকৃতিক শোভায় সৌন্দর্যমণ্ডিত, প্রাচীন বাংলার মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নদ-নদীগুলো মাতৃকার ন্যায় বিরাজমান তাই বলা যায়, নদ-নদীগুলো ছিল প্রাচীন বাংলার প্রাণস্বরূপ ।