বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠায় শাজারের অবদান আলোচনা কর
বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠায় শাজারের অবদান আলোচনা কর |
বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠায় শাজারের অবদান আলোচনা কর
- অথবা, বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠায় শাজার- উদ-দারের অবদান মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : আইয়ুবী বংশের দুর্দিনে সুলতান মালিক আস সালিহ পতনকে রোধ করার জন্য তাঁর সৈন্য বাহিনীতে বেশ কিছু তুর্কি ক্রীতদাস নিয়োগ করেন।
পরে এরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। আর এ তুর্কি ক্রীতদাসরই পরবর্তীতে বিশাল মামলুক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে । ইসলামের ইতিহাস পঠন-পাঠনে যে সকল বিষয় খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয় তার মধ্যে মিশরের মামলুক শাসন অন্যতম।
ইহা এমন একটি রাজনৈতিক প্রত্যায় যা বিশ্বজনীন এক ঘটনা। রাণী শাজার-উদ-দার কর্তৃক মিশরে মামলুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
শাজার-উদ-দার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বংশকে বাহারি মামলুক নামেও অভিহিত করেছে ঐতিহাসিকরা। বাহারি মামলুক শাসকগণ মিশরে ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় ছিলেন ।
→ বাহারি মামলুকদের পরিচয় : আরবি "মালাকা" শব্দ, থেকে মামলুক শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ দাস, চাকর, ক্রীতদাস ইত্যাদি। আগেকার দিনে মিশরে যুদ্ধ বন্দিদেরও মামলুক বলে ডাকা হতো।
এই মামলুকদের অধিকাংশ লোকই ছিল তুর্কি শাখার কুমান গোত্রের। এরা বসবাস করত উরাল পর্বতমালা এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী কিপচাক অঞ্চলে।
তাঁরা এ সময় মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পশ্চিমে এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং মিশরে চলে আসেন। জন্মগতভাবেই এই তুর্কিগণ ছিলেন দুঃসাহসী।
ফলে আইয়ুবী সুলতান আস সালিহ তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীতে বেশ কিছু সৈন্যকে নিয়োগ দেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং কায়রোবাসীর উপর নির্যাতন শুরু করেন।
ফলে সুলতান তাদের একটা বড় অংশকে নগরীর বাইরে ফুসতাত নগরীর বিপরীত প্রান্তে নীলনদের অববাহিকায় "রাওদাহ" নামক দ্বীপে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। সুলতান তাদের বাহারিয়া বলে ডাকতেন বলে পরে এরা বাহারি মামলুক নামেই ইতিহাসে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে ।
বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠায় শাজার-উস-সারের অবদান : নিম্নে বাহারি মামলুক বংশ প্রতিষ্ঠার শাজার-উদ-দারের অবদান সম্পর্কে কর্ণনা করা হলো :
১. শাজার উদ-দারের পরিচয় : মিশরের ইতিহাসে যে কয়জন মহীয়সীর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে সুলতানা শাজার-উস- দার তন্মধ্যে অন্যতম। প্রথম জীবনে তিনি একজন সামান্য তুর্কি ক্রীতদাসী ছিলেন।
পরে সেখান থেকে তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাসিমের হেরেমে আশ্রয় লাভ করেছিলেন। শাজার-উন- দার ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে অনুগ্রহণ করেন।
২. আল সালিহের সাথে পরিচয় : শাজার-উদ-দার এক আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাসিম বিল্লাহ উপঢৌকন হিসেবে শাজার-উল-দারকে মিশরের আইয়ূবীয় সুলতান আস সালিহের দরবারে প্রেরণ করেন।
পরে সুলতান আস সালিহ তাকে মুক্তি দিয়ে নিজ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে নতুন জীবনে প্রবেশ করেন শাজার-উদ-দার।
৩. শাজারের উত্থান : সুলতান মালিক আস সালিহ শালারকে বিয়ে করে তাকে যুক্ত করে দেন। বিয়ের পর রাজ্যে সালের এর প্রভাব-প্রতিষ্ঠি বৃদ্ধি পায়। সুলতান আস সালিহ ও তাঁর স্ত্রী শাজারের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
ফলে শাজার-উদ-দার সুলতানের উপর তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকেন এমনকি মুদ্রায় খলিফার সাথে নিজ নাম অঙ্কন এবং খুতবায় নিজ নাম পাঠের ব্যবস্থা করেন।
৪. আয়ুবীয় সুলতান আস সালিহের মৃত্যু : শাজারের প্রভাব প্রতিপত্তি যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, তখন ১২৪৯ সালে সুলতান আস সালিহ মৃত্যুবরণ করেন। ফলে সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়ায় আস সালিহের পুত্র তুরান শাসনভার গ্রহণ করেন।
৫. ভুরান শাহের হত্যাকাণ্ড : এদিকে পিতা সালিহের মৃত্যুর সময় তাঁর পুত্র তুরান শাহ দামিয়োয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। যুদ্ধে ভুরান শাহ ফ্রান্সের নবম লুইকে পরাজিত করে এবং বন্দি করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।
তুরান শাহ আইয়ূবীয় সিংহাসনে বসলে উচ্চাভিলাসী শাজার-উদ-দার সুকৌশলে সেনাপতি বাইবার্সের মাধ্যমে তুরান শাহকে হত্যা করান।
৬. শাজার-উস-সারের ক্ষমতারোহণ : আইয়ূবী বংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর মসনদে বসতে শাজারের আর কোনো প্রতিপক্ষ অবশিষ্ট থাকল না। ফলে আমির ওমরাহনের সমর্থন নিয়ে৷ ১৯৫০ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৭. মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠা : ১২৫০ সালে শাজার-উল-দারের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে এক নতুন রাজবংশের উত্থান হয়। যেহেতু শাজার তাঁর প্রথম জীবনে এক তুর্কি ক্রীতদাসী ছিলেন, তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মামলুক বংশ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
আর যেহেতু তিনি মামলুকদের বাহারি শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বাহারি মামলুক বংশ নামেও পরিচিতি লাভ করে।
৮. শাজার-উদ-দারের কূটকৌশল : ১২৫০ সালে শালার-উদ- দার ক্ষমতায় বসার পর মাত্র ৩ মাস রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু আমির ওমরাহগণ একজন মহিলার শাসন মেনে নিতে না পারায় তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন।
ফলে আন্দোলন ঠেকানোর জন্য শাজার-উল- দার এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সেনাপ্রধান ইজ্জাতদিন আইবেককে বিয়ে করে তাঁর অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
৯. আইবেকের হত্যাকাণ্ড : ইজ্জাতদিন আইবেক ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা শাসক। তাই তিনি সাম্রাজ্যের পরিচালনায় সুলতানা শাহার-উদ-দারের প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
এদিকে ১২৫৭ সালে আইবেক রাজনীতির কৌশল হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশের রাজার বোনকে বিয়ে করেন। সাজার আইবেকের উপর ক্ষুব্ধ হন ।
ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শাজার-উদ-দার স্বামীর উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কৌশলে বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করেন ।
১০. সাজ্জারের মৃত্যু : এদিকে সুলতান ইজ্জাতদিন আইবেকের হত্যার পিছনে তাঁর স্ত্রী শাজার-উদ-দারের যড়যন্ত্র ছিল, তা হঠাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আইবেকের সমর্থকগণ।
তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সম্পূর্ণভাবে শাজার-উদ-দারকে দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাকে প্রাসাদ থেকে টেনে হিচড়ে বের করে প্রকাশ্যে হত্যা করেন।
১১. খলিলের সিংহাসনারোহণ : উন্মুক্ত জনতা শাজার-উল- দারকে হত্যা করলে মামলুক সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় রাজ্যের আমির ওমরাগণ আলোচনা করে সুলতান মালিক আল সালিহের ১৫ বছরের বালক পুত্র মালেক আল মনজুরকে মামলুক সিংহাসনে বসান।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান শাজার-উদ-দার। তিনি ক্রীতদাসী থেকে নিজ মেধা ও যোগ্যতাবলে অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
ফলে সুলতান মালিক আল সালিহের মৃত্যুর পর ১২৫০ সালে তিনি আইয়ুবী বংশের পতন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মামলুক রাজবংশ।
শাজার-উদ-দার ছিলেন বাহারী মামলুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও ইতিহাসে শাজার-উদ-দার তার অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।