অটোমান সুলতান কর্তৃক মিশর বিজয়ের কারণসমূহ আলোচনা কর
অটোমান সুলতান কর্তৃক মিশর বিজয়ের কারণসমূহ আলোচনা কর |
অটোমান সুলতান কর্তৃক মিশর বিজয়ের কারণসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম কর্তৃক মিশর বিজয়ের কারণ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : ইতিহাস পঠন-পাঠনে যে সকল বিষয় খুবই গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয় তার মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান অন্যতম।
আর অটোমান সালতানাতের ইতিহাসে সুলতান প্রথম সেলিম এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে অটোমানগণ মিশর বিজয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৫১৬ সালের ঐতিহাসিক মারজ-ই- দাবিকের যুদ্ধে প্রথম সেলিমের হাতে মামলুক সুলতান কানসু আল ঘুরির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মিশরে মামলুক শাসনের অবসান ঘটে এবং পরবর্তীতে তুমান বে এর ফাঁসির মাধ্যমে অটোমান সালতানাতের অভ্যুদয় ঘটে।
প্রথম সেলিমের পরিচয় : অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম ছিলেন আরেক দিগবিজয়ী বীর সুলতান বায়েজিদের পূত্র। প্রথম সেলিম ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের আমাসিয়াতে অংশগ্রহণ করেন।
তার পিতার নাম বায়েজিদ খান এবং মাতার নাম গুলবাহার হাতুন। ১৫১২ সালে বায়েজিদের মৃত্যুর পর প্রথম সেলিম সিংহাসনে আরোহণ করেন। যদিও প্রথম সেলিমের শাসনকাল ছিল ৮ বছর।
কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এমন সব কার্যকলাপ করেন, যা আজও তাকে মিশরের ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খলিফা।
→ মিশর বিজয়ের কারণসমূহ : সুলতান প্রথম সেলিম অটোমান সিংহাসনে আরোহণের পর নানা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমন করে এবার মিশর বিজয়ে মনোনিবেশ স্থাপন করেন। তাঁর মিশর বিজয়ের পেছনে যে কারণগুলো বিদ্যমান ছিল সেগুলো ছিল নিম্নরূপ।
১. সীমান্ত দ্বন্দ্ব : সুলতান প্রথম সেলিম ১৫১৪ সালে পারস্য আক্রমণ করলে পার্শ্ববর্তী মিশরীয় মামলুক সুলতান এটাকে নিজ রাজ্যের প্রতি হুমকি বিবেচনা করে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেন। মামলুক সুলতানের এই সৈন্য সমাবেশকে প্রথম সেলিম ভালোভাবে গ্রহণ করেননি।
২. সামরিক ঘাঁটি পুনরুদ্ধার : সুলতান ২য় বায়েজিনের দুর্বলতার সুযোগে মামলুক শাসক কায়েত বে এশিয়া মাইনরে অটোমানদের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিল। ক্ষমতায় আসীন হয়ে সুলতান প্রথম সেলিম উক্ত ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেন।
৩. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ : ইতোপূর্বে প্রথম সেলিম যখন পারস্য অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তখন মামলুক সুলতান কানসুয়া আল-ঘুরি তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রথম সেলিম যখন ১৫১৪ সালে পারস্য আক্রমণ করেন তখন মামলুক সুলতান তাঁর পূর্বোক্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেন।
৪. মঞ্চ -মদিনার রক্ষণাবেক্ষণ : এতদিন মক্কা ও মদিনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মামলুকদের হাতে থাকায় মুসলিম বিশ্বে তাদের মর্যাদা ছিল।
ফলে প্রথম সেলিম মক্কা-মদিনার প্রাধান্য লাভের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ইচ্ছা করলে মক্কা-মদিনার আধিপত্য নিয়ে মামলুক ও অটোমানদের দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
৫. মামলুকদের অত্যাচার : মামলুক শাসকগণ প্রথম পর্যায়ে জনহিতৈষী থাকলেও ধীরে ধীরে তারা জনগণের উপর অত্যাচার শুরু করেন। তাদের জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সিরিয়ার জনগণ অটোমানদের সিরিয়া আক্রমণের আহ্বান জানায়।
৬. শিয়া বিরোধী নীতি : অটোমান সুলতানগণ ছিল সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। অন্যদিকে, মামলুকগণ ছিল চরমপন্থি শিয়া | মতবাদে বিশ্বাসী। ফলে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের শিয়া বিরোধী নীতির ফলেও তিনি মিশর বিজয়ে মনোনিবেশ করেন।
৭. সেলিম-ইসমাইল : সুলতান প্রথম সেলিম যখন শিয়াদের দমনে অভিযান চালান তখন পারস্যের শাসক ইসমাইল অটোমান সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার হুমকি দেন। ফলে প্রথম সেলিম পারস্য অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
৮. বিদ্রোহীদের আশ্রয়দান : এ সময় প্রথম সেলিমের ভ্রাতা আহমদ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মিশরের মামলুক সুলতান কানসুয়া আল ঘুরির আশ্রয় লাভ করেন।
সুলতান সেলিম বিদ্রোহী ভ্রাতা আহমদকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানালে, কানসু আল ঘুরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে সেলিমের মিশর অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।
৯. ইসমাইলকে আশ্রয় দান : পারস্য অধিপতি শাহ ইসমাইল সেলিমের নিকট পরাজিত হয়ে মিশরে মামলুক সুলতান কানসুয়া আর ঘুরির নিকট আশ্রয় লাভ করেন।
এই ঘটনার সুলতান প্রথম সেলিম মামলুক সুলতান আল ঘুরির উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তিদানের ইচ্ছা করেন।
১০. আল মুরির ষড়যন্ত্র : এদিকে মামলুক সুলতান আল ঘুরি অটোমান সুলতানের মিশর অভিযানের কথা বুঝতে পেরে শাহ ইসমাইল ও প্রথম সেলিমের মধ্যে সমঝোতা করার নামে শাহ ইসমাইলের পক্ষে গোপন ষড়যন্ত্র করেন।
কিন্তু সেলিমের গোয়েন্দারা ঘুরির অভিসন্ধি ধরে ফেললে কানসুয়া আল ঘুরি সেলিমের রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেন। ফলে প্রথম সেলিম ক্রোধান্বিত হয়ে মিশর অভিযানে সৈন্য পরিচালনা করেন।
→ মিশর বিজয়ের ঘটনা : মামলুক সুলতান প্রথম সেলিমের ক্রমাগত ষড়যন্ত্র এবং অটোমান বিরোধী তৎপরতার ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে অটোমান সুলতান সেলিম ১৫১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিশর অভিযানের উদ্দেশ্যে গাজা অভিমুখে অগ্রাভিযান চালায়।
মাত্র ১০ দিনে তিনি সিন্নাই উপত্যকা অতিক্রম করে গাজায় উপনীত হন। এদিকে মিশরে মামলুক সুলতান কানসু আল ঘুরি প্রথম সেলিমকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়।
ফলে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট মারজ-ই-দাবিব প্রান্তে মোঙ্গল ও মামলুকদের এটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কানসু আল ঘুরি নিহত হন। ইতিহাস একটি মারজ-ই যুদ্ধ নামে পরিচিত।
কিন্তু ইতোমধ্যে সেলিমের বাহিনী কায়রো আসলে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয় এবং মরণপণ যুদ্ধ করেও তুমান বে পরাজিত ও বন্দি হন। তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হলে মিশরে মামলুক বংশের পতন ঘটে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৫১৬ সালে প্রথম সেলিমের মিশর বিজয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
তন্মধ্যে আল ঘুরির নিরবচ্ছিন্ন অটোমান বিরোধিতা, বিদ্রোহীদের আশ্রয় দান, মক্কা-মদিনার প্রাধান্য লাভ ইত্যাদি। মিশর বিজয়ের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে করদ রাজ্যে পরিণত হয়।
অলিম কতৃক প্রতিষ্ঠিত এ সাম্রাজ্য ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। আর তাই ইতিহাসে মামলুক ও অটোমানদের গুরুত্ব অত্যাধিক ।