অন্ধকূপ মৃত্যুর পটভূমি আলোচনা কর
অন্ধকূপ মৃত্যুর পটভূমি আলোচনা কর |
অন্ধকূপ মৃত্যুর পটভূমি আলোচনা কর
- অথবা, ‘অন্ধকূপ হত্যা' সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে নবাব সিরাজ-উদ- দৌলার স্বল্পসময়ের রাজত্বকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাতামহ আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ- উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সিংহাসনে আরোহণের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাকে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নবাব বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।
যার ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথেও তার বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ বিরোধের এক পর্যায়ে নবাব ইংরেজদের শায়েস্তা করতে গিয়ে কলকাতা আক্র করে ল করে নেন।
কলকাতা জয় ক প্রেক্ষিতে উদ্ভূত হয় হলওয়েল বর্ণিত 'অন্ধকূপ হত্যা' সম্পর্কিত ঘটনা। ভীর্যের উপর নেতিবাচকতা ও কার্লমা লেপন করে।।
অন্ধকূপ হত্যার পটভূমি : ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজ- উস-দৌলা কলকাতা জয় করার পরিপ্রেক্ষিতে অন্ধকূপ হত্যার জন্য দেন। নিম্নে অন্ধকূপ হত্যার পটভূমি আলোচনা করা হলো :
১. সিরাজের সিংহাসনে আরোহণ : নবাব আলীবর্দী খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তার তিন কন্যা ছিল। তিন কন্যাকেই তিনি তার বড় ভাই হাজী আহমদের তিন পুত্রের সঙ্গে বিবাহ নিয়েছিলেন।
১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কনিষ্ঠা কন্যা আমেনা কোমের গর্ভে সিরাজ-উদ-দৌলার জন্ম হয়। সিরাজ-উদ- দৌলার পিতা জয়নুদ্দীন আহমদ খান বিহারের ডেপুটি নবাব ছিলেন।
১৭৪৮ সালে তিনি আফগান বিদ্রোহীদের হাতে তিনি প্রাণ হারান। এসময় আলীবর্দী খান সিরাজকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান।
এ সুবাদে মাতামহের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১০ এপ্রিল সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব পদে অভিষিক্ত হন।
সিংহাসনে আরোহণের পরপরই তরুণ নবাব চারদিক থেকে শত্রু পরিবেচিত হয়ে পড়েন। যার ফলশ্রুতিতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বেশকিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। অন্ধকূপ হত্যা তার মধ্যে একটি।
২. ইংরেজ কর্তৃক নবাবের আদেশ অমান্য : ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা যখন বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন বাংলায় অবস্থানরত অন্যান্য বণিক সম্প্রদায় ফরাসি, ডাচরা নবাবকে উপহার উপঢৌকন প্রদান করে নবাবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, কিন্তু ইংরেজরা নবানের প্রতি কোনোরূপ উপহার উপঢৌকন প্রদান করা থেকে বিরত থাকে।
তাছাড়া তারা নবাবের আদেশ অমান্য করে নানারূপ অবৈধ বাণিজ্য করতে থাকে। ইংরেজরা শওকত জঙ্গ এবং ঘষেটি বেগমের ষড়যন্ত্রের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে নবাবের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে নবাব ইংরেজদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। যার ফলশ্রুতি কলকাতা আক্রমণ ও অন্ধকূপ হত্যা ।
৩. ইংরেজ কর্তৃক দুর্গ নির্মাণ : নবাব আলীবর্দী খান ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য করার অনুমতি দিলেও দুর্গ নির্মাণ করার অনুমতি দেননি। কিন্তু আলীবর্দীর মৃত্যুর সুযোগে এবং ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসিরা।
এদেশে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাদের এরূপ কার্যক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দুর্গ নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত অংশ ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন।
ফরাসিরা নবাবের আদেশ মানা করে কিন্তু ইংরেজরা নবাবের আদেশ্য মান্য না করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে আরো দুর্ভেদ্য করে তোলে। ইংরেজদের এরূপ কার্যে নবাব বিক্ষুব্ধ হন এবং শাস্তি প্রদানে বদ্ধপরিকর হন।
৪. দপ্তকের অপব্যবহার : ১৭১৭ সালে সম্রাট ফরুরুখ শিয়ার এক ফরমান বলে বাংলায় অবস্থানরত ইউরোপীয় বণিকদের বিনাতষ্কে বাণিজ্য করার সংবলিত একটি আদেশনামা জারি করেন।
যা দত্তক নামে পরিচিত। কিন্তু অচিরেই দত্তকের অপব্যবহার শুরু হয়। মুর্শিদকুলীর সময় তা বন্ধ থাকলেও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনকালে ইংরেজ কর্মচারীরা পুনরায় দস্তকের অপব্যবহার করা শুরু করে।
ফলে বাংলার বণিক সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।তাছাড়া পত্তকের অপব্যবহারের দরুন নবাবের রাজকোষ শূন্য হতে থাকে।
নবাব ইংরেজ গভর্নর ড্রেককে দত্তকের অপব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করলেও ড্রেক তা অগ্রাহ্য করে। এসব ঘটনা নবাবকে কলকাতা আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে।
৫. কলকাতা অধিকার : ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অবাধ্যতা নবাবকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য ১৭৫৬ খ্রিঃ জুন মাসের শুরুতে নবাব কলকাতা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৭৫৬ সালের ১৬ মে সিরাজ মুর্শিদাবাদ থকে সলৈনো শওকত জঙ্গকে দমন করার উদ্দেশ্যে পূর্ণিয়ার দিকে অগ্রসর হন। ২০ মে তিনি যখন রাজমলের পৌঁছান তখন ইংরেজ গভর্নর ড্রেক প্রদত্ত পর তার হস্তগত হয়।
এই পরে ট্রেক ইংরেজদের সদিচ্ছার কথা অতি নম ভাষায় সিরাজ-উদ-দৌলাকে জানালেও দুর্গ নির্মাণ বন্ধ হবে কিনা সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেননি।
এতে ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পূর্ণিয়ার দিকে অগ্রসর না হয়ে মুর্শিদাবাসে ফিরে আসেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতার ইংরেজনের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে যাত্রা করেন।
পথিমধ্যে তিনি কাসিমবাজার কুঠি দখল করে নিয়ে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। ১৬ জুন সিরাজ কলকাতার উপকণ্ঠে পৌঁছান।
কলকাতা দুর্গের সৈন্য সংখ্যা তখন খুবই অল্প ছিল- কার্যক্ষম ইউরোপীয় সৈন্যের সংখ্যা তিনশ'রও কম ছিল এবং ১৫০ জন আর্মেনিয়ান ও ইউরেশিয়ান সৈন্য ছিল।
কলকাতাস্থ ইংরেজ ঘাঁটি ফোর্ট উইলিয়াম দখল করতে সিরাজকে বেগ পেতে হয়নি। গভর্নর ড্রেক ও অপরাপর ইংরেজগণ ফোর্ট উইলিয়াম ত্যাগ করে জাপথে ফলতা নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
২০ জুন কলকাতার নতুন গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন এবং বিজয়ী সিরাজ কলকাতার দুর্গে প্রবেশ করেন।
৬. অন্ধকূপ হত্যা : নবাব সিরাজ কলকাতা অধিকার করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করেন। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল প্রসঙ্গেই 'অন্ধকূপ হত্যা' বা Black Hole Tragedy' নামক বীভৎস কাহিনির সৃষ্টি হয়।
ইংরেজ কর্মচারী ও লেখক হলওয়েল এ কাহিনির স্রষ্টা। হলওয়েলের কাহিনিতে বলা হয়, ১৮" × ১৪" - ১০" একখানি অতিক্ষুদ্র কক্ষে সিরাজ-উদ-দৌলার আদেশে ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দিকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং এদের মধ্যে ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল।
সিরাজ কর্তৃক সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডকে অন্ধকূপ হত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও এ কাহিনিকে অতিরঞ্জন করা হয়েছে, তথাপি এর পিছনে যেকোনো সত্যি ছিল না তা বলা যায় না।
কেননা সিরাজ-উদ-দৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে যে সকল ইংরেজ তখনও সেখানে ছিল তাদেরকে রাতে কোথায় রাখা যেতে পারে সেই প্রশ্ন করলে ইংরেজগণ ফোর্ট উইলিয়ামের অভ্যন্তরস্থ অন্ধকূপ নামক কক্ষটির উল্লেখ করেছিল।
কারণ ইংরেজ অপরাধীগণকে ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃপক্ষ ঐ কক্ষে আবদ্ধ রাখতেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা স্বভাবতই ঐ কক্ষে ইংরেজ বন্দিদেরকে রাতের জন্য আবদ্ধ করে রাখতে আদেশ দিয়েছিলেন।
ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণকালে আঘাতপ্রাপ্ত দু'একজনও বন্দিদের মধ্যে স্বভাবতই ছিল এবং নবাবের অধস্তন কর্মচারীদের অসাবধানতাশত তাদের কেউ কেউ রাতে ঐ কক্ষে হয়তো মারা গিয়েছিল। এভাবেই অন্ধকূপ হত্যা সম্পর্কিত ঘটনার উৎপত্তি হয়েছিল।
উপসংহার : আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, নবাব সিরাজ-উদ- দৌলা সিংহাসনে বসার পর থেকে নানা কারণে ইংরেজদের সাথে নবাবের বিরোধ দেখা দেয়।
এ বিরোধের জের ধরে নবাব ১৭৫৬ সালের জুন মাসে কলকাতা আক্রমণ করেন এবং কলকাতা দখল করে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন।
কলকাতা দখল করে ইংরেজ বন্দিদের কারারুদ্ধ করতে গিয়ে নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের একটি কক্ষে আবদ্ধ রাখেন।
সেখানে রাতে বেশকিছু সৈন্য আহতাবস্থায় বা অন্যান্য কারণে মারা যায়। এ ঘটনাকে হলওয়েল অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করেন। যা ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত ।