আইয়ুবী বংশের পতন ও ক্রুসেডের ফলাফল আলোচনা কর
আইয়ুবী বংশের পতন ও ক্রুসেডের ফলাফল আলোচনা কর |
আইয়ুবী বংশের পতন ও ক্রুসেডের ফলাফল আলোচনা কর
- অথবা, আইয়ুবী বংশের পতন কিভাবে হয়েছিল এবং ক্রুসেডের ফলাফল তুলে ধর।
উত্তর : ভূমিকা : দীর্ঘকাল রাজত্ব করার পর ১২৫০ সালে সুলতান তুরান শাহ -এর পতনের মাধ্যমে আইয়ুবী বংশের পতন ঘটে। পবিত্রভূমি জেরুজালেমের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ব্যাপি যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তাই ইতিহাসে ক্রুসেড নামে পরিচিত। এশিয়ার মুসলমান এবং ইউরোপের খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরাজিত সুদীর্ঘকালের ঘৃণা-বিদ্যে ও দ্বন্দ্ব-কলহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ক্রুসেডের মাধ্যমে। তাই এই ক্রুসেডের কারণ ও ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
আইয়ুবী বংশের পতন : মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের আক্রমণ প্রতিহত এবং সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরের বিশৃঙ্খল দমন করার জন্য আইয়ুবী বংশের সুলতান মালিক আস সালিহ তুর্কি ক্রীতদাসদেরকে সুযোগ দিয়ে তার দেহরক্ষী বাহিনী এবং সেনাবাহিনী তৈরি করে।
পরবর্তীতে এই তুর্কিরা অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাসিম বিল্লাহ শাজার-উল-দার নামের এক ক্রীতদাসীকে উপহার স্বরূপ মালিক আস সালিহের দরবারে প্রেরণ করেন।
মালিক আস সালিহ উক্ত ক্রীতদাসীকে নিজের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে মালিক আস সালিহ মৃত্যুবরণ করলে শাজার-উদ-দার তার সতিনের পুত্র ডুরান শাহের পক্ষে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
দামিয়েতায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান সমাপ্ত করে তুরান শাহ কায়রো ফিরে এসে আইয়ুবীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন।
কিন্তু শাজার-উদ-দার সেনাপতি বারবার্গের সহযোগিতায় ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের ২ মে তুরান শাহকে হত্যা করে এবং মিশরের সিংহাসনে বসেন। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় মামলুক বংশ। আর এরই সাথে আইয়ুবী বংশের পতন ঘটে।
ক্রুসেডের ফলাফল : ক্রুসেড যদিও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক পরিচা ভূমি জেরুজালেম উদ্ধার করার জন্য পরিচালিত হয়। তথাপি এর ফলাফল জেরুজালেম কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রকৃতপক্ষে এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
নিম্নে সেচের ফলাফল তুলে ধরা হলো :
১. ধর্মীয় ফলাফল : ইসলামের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ক্রুসেডের ফলে একে অপরের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। যা আজও শেষ হয়নি।
২. রাজনৈতিক ফলাফল : ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে ইউরোপের সামন্তপ্রাণা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। ২০০ বছর ব্যাপী ধর্মযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ইউরোপের নাইট ও ব্যারনগণ তাদের ধনসম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপে সামন্তপ্রভুদের শক্তি লোপ পায়। তারা রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে।
৩. সামাজিক ফলাফল : ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে সামস্তপ্রভুদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এতে তাদের অনেক ধন-সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়। ধারাবাহিকভাবে সামন্তপ্রথা দুর্বল হয়ে যায়। তাদের অবসানে মধ্যযুগের অবতারণা ঘটে।
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে বাইজান্টাইনদের পরিবর্তে যুদ্ধে বা ক্রুসেডে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স ইউরোপীয় শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
৪. অর্থনৈতিক ফলাফল : ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে প্প্তচ্যের মাঝে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
যা পরবর্তীতে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরো গতিশীল করে দেয় ।ক্রুসেডের মাধ্যমে উভয়া অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা সুযোগ বৃদ্ধির জন্য অনেক জাহাজ নির্মাণ করতে হয়।
এ ছাড়া ঐ সময় তীর্থযাত্রী বহন একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দাঁড়ায়। যা তাদের জাহাজ বা এ জাতীয় বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে নেয়।
৬. সামরিক ফলাফল : ক্রুসেডের ফলে পশ্চিম ইউরোপ সামরিক কলাকৌশল উন্নত করার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের দুর্গ নির্মাণ বিভিন্ন কলাকৌশল, যুদ্ধের নিয়মকানুন ইউরোপের সমর বিজ্ঞানে প্রভাব ফেলে।
৫. সাংস্কৃতিক ফলাফল : এই যুদ্ধের ফলে পাশ্চাত্য দেশগুলে | প্রাচ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে উভয়ের ধর্মপ্রচার ও সাংস্কৃতিক প্রসারতা লাভ করে।
৭. শিক্ষা ক্ষেত্রে : শিক্ষা ক্ষেত্রেও ক্রুসেড প্রভাব বিস্তার করে। প্রাচ্যের উন্নত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সাথে ইউরোপ দারুণভাবে এগিয়ে চলে।
যা তাদের আধুনিকতার রূপ দিতে সহায়তা করে। ঐতিহাসিক টয়েনবি যথার্থ বলেছেন, | ক্রুসেড ফলে আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করেছে।
৮. কৃষিক্ষেত্রে : ক্রুসেড ইউরোপের কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এ যুগ্ধেনা ফলে প্রাচ্যের বিভিন্ন ফলমূল ইউরোপে | প্রচলিত হয়।
পরবর্তীতে এগুলো ব্যবহার তৈরিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে তাল, লেবু, চিনি, তরমুজ ইত্যাদি।
৯. সামস্ত প্রথার অবনতি ও পতন : ইউরোপে সামন্ত প্রথার অবনতি ও পতন ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ফল। কারণ, ক্রুসেড চলাকালীন যুদ্ধের ব্যায় নির্বাহের জন্য ইউরোপীয় সামন্তগণ তাদের সম্পদ বিক্রি করতে বা অন্যের নিকট বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধের শোচনীয় পরিতি তাদের আর্থিক কল্যাণ সাধন করতে পারেনি। ফলে অনেক সামন্ত প্রভু তাদের বিষয় সম্পত্তি হারিয়ে দুর্বলও হয়ে পড়েন। পরিণামে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয় বিশ্ব।
১০. উভয় অঞ্চলের ভাবধারার বিকাশ : সেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক ধারার বিনিময় ঘটে। এছাড়া পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাবধারা মুসলিম | সংস্কৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
১১. ফ্রান্স ইউরোপের শক্তির কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত : ক্রুসেড বা ধর্ম যুদ্ধের ফলে বাইজান্টাইনদের পরিবর্তে যুদ্ধে বা ক্রুসেডে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স ইউরোপীয় শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ফলে বাইজান্টাইনদের প্রাধান্য লোপ পায় এবং ইউরোপ, ধর্মীয় গোড়ামী থেকে বের হয়ে আসে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ প্রথমে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও পরবর্তীতে এর পরিধি শুধু জেরুজালেমে সীমাবদ্ধ ছিল না।
এক সময় এক সময় বিস্তৃতি লাভ করে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এ যুদ্ধে খ্রিস্টান গোঁড়া সম্প্রদায়ের প্ররোচনার উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনগণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ব্যাপক এ ভয়াবহ যুদ্ধ মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও এশিয়ার ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। ধর্মীয় কারণে যুদ্ধ শুরু হলেও এর ফলাফল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিস্তার লাভ করে।