১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয় কেন
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয় কেন |
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয় কেন
- অথবা, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার কারণ কি?
- অথবা, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ কি সিপাহি বিদ্রোহ নাকি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তোমার যুক্তি তুলে ধর।
- অথবা, যুক্তি উল্লেখপূর্বক আলোচনা কর ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ কি সিপাহি বিদ্রোহ নাকি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ?
উত্তর : ভূমিকা : ১৮৫৭ সালের ৯ মে মিরাটের একদল সিপাহি এনফিল্ড কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে।
এ বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ না ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সেটি নিয়ে ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মহলে বিতর্ক রয়েছে।
→ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রকৃতি : ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ কি সিপাহি বিদ্রোহ নাকি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ সে বিষয়ে যুক্তিতর্ক তুলে ধরা হল :
১. ইংরেজ লেখক জে. বি. নর্টন তার 'Topics for India Statesman' গ্রন্থে প্রথম লেখেন ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ একটি অসামান্য সিপাহি বিদ্রোহ ছিল। এই অভ্যুত্থান একটি গণ- বিদ্রোহে রূপ নিয়েছিল।
ডাফ, উইলিয়াম কে, ম্যালেসন প্রভৃতি ইংরেজি লেখকও জে.বি. নর্টনের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন।
ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের অনেকে এই মহাবিদ্রোহে ইংরেজদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার একটি সংগঠিত প্রয়াস দেখতে পেয়েছেন এবং অনেকেই এটিকে মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেছেন।
২. রজনীকান্ত গুপ্ত তার “সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস” গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে, সিপাহিরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিল। বীর সাভারকারও ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানকে একটি জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৩. ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী তার 'Civil Rebellion in the Indian Mutinies' গ্রন্থে বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি এটিকে গণ বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
৪. কার্ল মার্কস New York Daily Tribune' পত্রিকায় ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সম্পর্কিত প্রবন্ধে এটিকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যাঁদের মতে, এ বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ তাদের যুক্তি তুলে ধরা হল :
(ক) Charles Railkes নামক একজন ইংরেজ বিচারপতি তার 'Notes on the Revolt in Northern Western Province of India'-তে লিখেছেন ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি সিপাহি বিদ্রোহ। ব্রিটিশ কর্তৃত্ব শিথিল হবার কারণে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
(খ) ১৮৫৭ সালের ভারতীয় লেখক কিশোরীচাঁদ মিত্র লেখেন- এই বিদ্রোহ ছিল অবশ্যই কেবলমাত্র সিপাহিদের অভ্যুত্থান। ১ লক্ষ সিপাহি এতে অংশ নিয়েছিল। এই অভ্যুত্থান গণ-বিদ্রোহের ছিটেফোঁটাও ছিল না।
(গ) L.E.R. Resse এই বিদ্রোহকে ধর্মান্ধ হিন্দু ও মুসলমানদের খ্রিষ্টধর্ম বিরোধী জিহাদ হিসেবে দেখেছেন।
(ঘ) স্যার সৈয়দ আহমদ, জনৈক সামরিক কর্মচারী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির মতে এটি ছিল সিপাহি বিদ্রোহ।
ড. আর. সি. মজুমদার ইংরেজ লেখক চার্লস রাইকসের মন্ত ব্য সমর্থন করে বলেন, এ বিদ্রোহ প্রথমে সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবেই শুরু হয়।
কিন্তু পরে কোনো কোনো অঞ্চলে এটি ব্যাপক প্রসার লাভ করে জাতীয় আন্দোলনের রূপ লাভ করে। তিনি বলেন, জাতীয় সংগ্রামের পেছনে সবসময় দেশপ্রেম, সুপরিকল্পনা, সংগঠন ও শৃঙ্খলাবোধ থাকে যেটি বিদ্রোহের সময় দেখা যায়নি ।
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সমগ্র ভারতব্যাপী বিস্তৃত ছিল না। ভারতের বহু শাসক ও জমিদার শ্রেণি- এ বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের দৃঢ় সমর্থন জানায়। বেঙ্গল আর্মি ছাড়া অন্যান্য রেজিমেন্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ দেখা যায়নি ৷
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৫৭ সালের সংঘটিত বিপ্লবকে স্থানীয় সিপাহি বিপ্লব বলে তুচ্ছ জ্ঞান করা সমীচীন নয়।
১৮৫৭ সালের বিপ্লব প্রথমে সিপাহিদের দ্বারা শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। পশ্চিম বিহার থেকে পাঞ্জাবের প্রান্ত পর্যন্ত এ বিদ্রোহ ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করেছিল।