১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এটাকে কি জাতীয় অভ্যুত্থান বলা হয়


১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এটাকে কি জাতীয় অভ্যুত্থান বলা হয়
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এটাকে কি জাতীয় অভ্যুত্থান বলা হয়

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এটাকে কি জাতীয় অভ্যুত্থান বলা হয়

  • অথবা, ১৮৫৭ সালে কি কারণে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল? এটা কি জাতীয় আন্দোলন ছিল?
  • অথবা, ১৮৫৭ সালে ভারতের মহাবিদ্রোহের পটভূমি বিশ্লেষণ কর। সিপাহী বিদ্রোহ?

উত্তর : ভূমিকা : সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সিপাহী বিদ্রোহ সফল না হলেও এ বিদ্রোহ ভারতীয়দের মাঝে জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করেছিল তার হাত ধরেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন সর্বোপরি ভারতবাসী ইংরেজদের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে থাকে। 

তাদের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখালেখি হতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ এ বিদ্রোহের পর আর আগের মতো: রাষ্ট্র চালাতে পারেনি। এই সিপাহী বিদ্রোহই ভারতবাসীর মধ্যে ব্রিটিশ বিরুদ্ধ মনোভাব বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

— ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমি বা কারণ : নিম্নে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমি বা কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. রাজনৈতিক কারণ : সিপাহী বিদ্রোহের পিছনে অন্যতম কারণ হলো রাজনীতিতে ভারতীয়দের অবহেলার শিকার। ব্রিটিশ লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, সম্বলপুর, নাগপুর, ফাঁসি, তাঞ্জোর, অযোধ্যাসহ প্রভৃতি রাজ্য দখল করে। 

এছাড়া অযোধ্যা ও নাগপুরের নবাবের প্রাসাদ লুণ্ঠন করে। শুধু তাই নয়, জমিদারি পরিচালনার ব্যর্থতার অজুহাতে বহু জমিদারকে জমিদারি হারাতে হয়। আর এসব কারণে সিপাহীরা ক্ষেপে যায়। তারা দেশীয় এসকল ক্ষেত্রে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ মানতে পারছিল না ।

২. সামাজিক কারণ : সিপাহী বিদ্রোহের আরও একটি কারণ হলো ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয় কর্মচারীদের ঘৃণা, যা আগে ছিল না। এটা তাদের চরমভাবে আপমাণিত করে। ফলে দেশীয় কর্মকর্তা ও শাসিত শ্রেণির সাথে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়। 

এটা বিদ্রোহকে উসকে দেয়। তাছাড়া ব্রিটিশ কর্মচারীরা দেশীয় স্ত্রীলোকদের ধরে নিয়ে ব্যাভিচার করতো যা ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এছাড়া বিভিন্ন কাজে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের হেয় প্রতিপন্ন করতো ।

৩. অর্থনৈতিক কারণ : দেশীয় কুটিরশিল্প ব্রিটিশ কৌশলের কারণে ধ্বংস হতে বসে এমনকি বন্ধও হয়ে যায়। তাদের শিল্পে উৎপাদিত খারাপ মানের পণ্য অল্প মূল্যে ভারতের বাজারে বিক্রি করতো। 

ফলে দেশীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। ভারতীয় সমাজে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। সমাজে হাহাকার লেগে যায়। 

এছাড়া সেনাবাহিনীতে দেশীয় সৈনিকদের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। তাদেরকে মাত্র মাসিক ৯০০ শত টাকা বেতন দেয়া হতো। আবার বিভিন্ন অজুহাতে বেতন কেটে রাখতো যা সৈনিকদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেয়।

৪. সামরিক কারণ : সামরিক বাহিনীতে তৎকালীন সময়ে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছিল। ইউরোপীয়দের সাঙ্গে দেশীয় সৈন্যদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য তৈরি করে রাখা হয়েছিল। 

এছাড়া ইউরোপীয় দেশীয় সৈন্যদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। যা নিলে দিনে ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও ইউরোপীয় সৈন্যদের সাথে দেশীয় সৈন্যদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া পদোন্নতিতেও দেশীয় সৈন্যদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো।

৫. ধর্মীয় কারণ : সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পিছনে ধর্মীয় কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বহুকাল ধরে ভারতীয় হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা লোপ করা, বিধবা বিবাহের প্রচলন করা ভারতীয় হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহের সঞ্চার করে। 

এছাড়া খ্রিষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে ভারতীয়দের ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি কারণে দেশীয় জনগণ ব্রিটিশদের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল।

৬. এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন : ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড নামে এক প্রকার রাইফেলের প্রচলন করেছিল। যার কার্তুজ চর্বি মাখানো থাকতো এবং তা দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে পুরতে হতো। 

গরু ও শুকরের চর্বি মাখানো চর্বি ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতের ধর্মনাশের গুজবও খুব কাজে লাগান। স্বভাবতই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভের সূচনা হলো। ১৮৫৭ সালে ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডে নামে এক সিপাহী প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

৭. সিপাহী বিদ্রোহ : সিপাহীরা ব্যারাকপুর থেকে মিরাট সেখান থেকে নিল্লিতে পৌঁছে বাহাদুর শাহকে সমর্থন করেন। এরপর একের পর এক পিরোজপুর, মোজাফর নগর, অযোধ্যা, পাঞ্জাব, নঘুরা, লক্ষ্মৌ, শাহজাহাপুর, ফতেহপুর, ফতেগড়, এলাহবাদ ইত্যাদি স্থানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। 

বিদ্রোহীরা জেলখানা ভেঙে বিদ্রোহীদের ছেড়ে দেয়। সরকারি খাজাঞ্চীখানা লুট করে। সিপাহীরা বিদ্রোহের ঘোষণা করলে সাধারণ জনগণও বিদ্রোহে যোগ দেয়।

—১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহ নাকি জাতীয় বিদ্রোহ :

১. সপক্ষে মতামত :

(ক) ইংরেজ লেখক জে.বি নটন তাঁর "Topic for Indian statesman" গ্রন্থে লিখেন, "১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ একটা সামান্য সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না। এ অভ্যুত্থান একটা গণবিদ্রোহে রূপ নেয়।”

(খ) ডাফ, উইলিয়াম কে, ম্যালেসন বলেন, “এ বিদ্রোহে তারা ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতাড়নের একটা সংঘবদ্ধ প্রয়াস দেখতে পেয়েছেন।”

(গ) রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর 'সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস' গ্রন্থে স্বীকার করেন যে, “সিপাহীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিল।”

(খ) বীর সাভাকারও ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানকে একটা জাতীয় যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

২. বিপক্ষে মতামত :

(ক) Charles Rhaikes বলেন, "১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল প্রকৃতপক্ষে একটা সিপাহী বিদ্রোহ। ব্রিটিশ কর্তৃত্ব শিথিল হওয়ার ফলে কোনো কোনো অঞ্চলে ভারতে অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।”

(খ) ভারতীয় লেখক কিশোরী চাঁদ মিত্র লেখেন, “এ বিদ্রোহ ছিল অবশ্যই সিপাহী অভ্যুত্থান। এক লক্ষ সিপাহী এ বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। এ অভ্যুত্থানে গণবিদ্রোহের কোনো ছিটেফোটাও ছিল না।”

(গ) ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার জন লরেন্স ও সিলি বলেন, “দেশদ্রোহী ও স্বার্থপর সিপাহীদের বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেন।" তাঁদের মতে, এ বিদ্রোহের পিছনে কোনো সংঘটিত নেতৃত্ব বা জনসমর্থন ছিল না।

ড. আর.সি মজুমদার তাঁর "The Sepoy Mutiny and The Revolt of 1857" গ্রন্থে বলেন, “এ বিদ্রোহ প্রথমে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হয় কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপক প্রসার লাভ করে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়।”

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সিপাহী বিদ্রোহ হঠাৎ করে একদিনে সংঘটিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজ শাসনাধীনে নানা জুলুম, নির্যাতন, অবহেলা ও বৈষম্যের স্বীকার হয়ে সিপাহীরা এ বিদ্রোহ শুরু করে। 

তারা এ বিদ্রোহ করে মূলত ইংরেজ সরকারকে ভারতবর্ষ থেকে দূর করার জন্য। তারা এ বিদ্রোহে প্রচুর ধ্বংসাত্মক কাজ করে যা ছিল দীর্ঘদিন ধরে দানাবাঁধা ব্রিটিশ কুশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ। 

এ বিদ্রোহের ফলে ভারতবর্ষে ইংরেজরা তাদের অবস্থান হারায়। তারা আগের মতো আর রাজ্য শাসন করতে পারেনি। 

প্রায় এক লাখের মতো সিপাহী জনতার বিদ্রোহে ব্রিটিশ সরকার অনুধাবণ করে যে ভারতবর্ষে তাদের শাসনকাল শেষ সময়ে এসে গেছে। 

এই জাগরণের সূত্র ধরেই ভারতে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয় এবং তারা সরকারের কাজের সমালোচনা শুরু করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ