১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ আলোচনা কর
১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ আলোচনা কর |
১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ আলোচনা কর
- অথবা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ বর্ণনা কর।
- অথবা, ১৭৭০ সালে বাংলায় সংঘটিত দুর্ভিক্ষের কারণ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরই ফলশ্রুতিতে ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ এক অভিনব শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
কারণ কোম্পানির প্রধান হিসেবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কোম্পানি সরাসরি শাসনভার গ্রহণ করলে গোলযোগ দেখা দিতে পারে।
তাই শাসনব্যবস্থায় তিনি দ্বৈততা আনয়ন করেন। আর এই দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলায় নেমে আসে এক চরম দুর্ভিক্ষ। যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ : বাংলা ১১৭৬ এবং ইংরেজি ১৭৭০ সালে বাংলায় কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণের ফলস্বরূপ মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। নিম্নে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের প্র কারণ আলোচনা করা হলো :
১. দ্বৈত শাসনের প্রভাব : ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর কী করে কম খরচে রাজস্ব আদায় করা যায় সেই পন্থা হিসেবে লর্ড ক্লাইভ দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করে। এর ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা নবাব ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে ভাগ করা হয়।
এ শাসনব্যবস্থায় ফৌজদারি বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পায় নবাব, অন্যদিকে রাজস্ব ও দেশরক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয় কোম্পানির হাতে।
অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় কোম্পানির হাতে থাকে দায়িত্বহীন ক্ষমতা এবং নবাব পান ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। এর ফলে সবান চিরতরে কোম্পানির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।
নবাবের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা না থাকায় নবাবকে অর্থের জন্য কোম্পানির উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে নবাব জনগণের উন্নয়নের জন্য কিছুই করতে পারত না।
কোম্পানির উপর এরূপ নির্ভরশীলতা ছিল দ্বৈত শাসনের চরম পরিণতি। যে পরিণতির জন্য পরবর্তীতে সংঘটিত হয় মহাদুর্ভিক্ষ।
২. কোম্পানির রাজস্ব আদায় নীতি : কোম্পানির রাজস্ব আসায় নীতি ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের অন্যতম প্রধান কারণ। কারণ, দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করার পর কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেলেও রাজস্ব কোম্পানির কোন কর্মচারীর মাধ্যমে আদায় করা হয়নি।
বরং বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয় রেজা খানকে এবং বিহারের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয় সিতাব রায়কে। রেজা খান ও সিতাব যায় অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে প্রজাসাধারণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে থাকে।
তারা যেকোনো মূল্যে পেতে মরিয়া ছিল। তাদের এ রাজস্ব নীতি ছিল জনকল্যাণ বিরোধী। ফলে বাংলার জনসাধারণের মধ্যে দুর্ভোগ বেড়ে যায়।
৩. কোম্পানির অন্যায়মূলক বাণিজ্যনীতি : ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৮০০ সালে বাণিজ্য করতে আসার মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষে আগমন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি সারা ভারতবর্ষে তাদের বাণিজ্য বিস্তার শুরু।
এভাবে ১৭১৭ সালে ফররুখশিয়ারের এক ফরমান বলে বিনাশুঙ্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। কিন্তু মুর্শিদকুলী খান, নবাব আলিবর্দী ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাসনকালে এব্যবস্থার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
পরবর্তীতে পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে কোম্পানি বাণিজ্য করার অগাধ সুযোগ লাভ করে। এতে অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির তুলনায়তো বটেই এমনকি দেশীয় বণিকদের চেয়ে তারা অধিকতর বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করতে থাকে।
এ সুবিধার সুযোগ নিয়ে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে এবং কমমূল্যে দ্রব্যাদি এর করে অধিক মূল্যে বিক্রি করতে থাকে।
বাণিজ্য থেকে সংগৃহীত অর্থ কোম্পানি ইংল্যান্ডে পাচার করতে শুরু করে। ফলে বাংলার অর্থনীতি ক্রমে ধ্বংস হতে থাকে। যারা পরিণতি ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ।
৪. খাজনা শোষণ : ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের পর থেকে দেশের সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু রাজস্বের হার প্রতিবছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সম্পর্কে রেজা খান অভিযোগ করেন যে, নবাব আলীবর্দী খানের আমলে পূর্ণিয়া জেলার বাৎসরিক রাজস্ব যেখানে মাত্র ৪ লক্ষ টাকা ছিল সেখানে ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তা বৃদ্ধি করে ২৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়।
জেলাকেও একইভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। এই অতিরিক্ত রাজ সংগ্রহ করতে রেজা খানের উপর চাপ দেয়া হয় এবং তিনি রাজস্ব আদায় করতে কঠোর ব্যবস্থা নেন। ফলে শুরু হয় নিদারুণ খাজনা শোষণ।
এতে করে প্রজাদের সীমাহীন দুর্দশা পোহাতে হয়। এ বিষয়ে কোম্পানির একজন কর্মচারী করেন, “কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে প্রজাদের যে দুর্দশান্ত সৃষ্টি হয়েছে, ইতিপূর্বে তা কখনো হয়নি। পূর্বের অনেক স্বেচ্ছাচারী নবাবের শাসনামলেও দেশের সুস্থ ও সম্পদ ছিল তা এখন ধ্বংসের সীমানায় দাড়িে
৫. কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি : পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কোম্পানির ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার ফলে কোম্পানির কর্মচারীদেরও মর্যাদা ও ক্ষমতার আধিক্য প্রকাশ পেতে থাকে।
তারা এর সুযোগ গ্রহণ করে নানারকম অন্যায়, দুর্নীতি করতে শুরু করে। তারা দন্তকের অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত ব্যবসাকে আরো মজবুত করে।
এসব কর্মচারী নানা পন্থায় দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এদেশের সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করতে থাকে। এসময় তারা দ্রব্যাদি মজুতদারীও শুরু করে।
কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য বাণিজ্য প্রদানে অস্বীকার করে। এর ফলে বাংলার কৃষক, বণিক সম্প্রদায় | চরমভাবে ক্ষতিহ্যস্ত হতে থাকে। যার ফল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ।
৬. প্রাকৃতিক কারণ : একদিকে কোম্পানির কর্মচারী গোমস্তাদের লুন্ঠন ও রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে ১৭৬৮ হতে পরপর দুই বছর মারাত্মক খরায় ফসলহানি ঘটায় এক খানা সংকট দেখা দেয় এবং খাদ্যশস্যের মূল্য অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায়।
টাকায় ১ মণ হতে চাউলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় তিন সেরে দাড়ায়। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যদিকে কোম্পানি সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্যোগ এ দুইয়ে মিলে বাংলার জনগণের নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম হয়। যার পরিণতিতে ইংরেজি ১৭৭০ সালে অর্থাৎ বাংলা ১১৭৬ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
৭. কোম্পানি ও কোম্পানির কর্মচারী কর্তৃক মতনীতি : ১৭৬৮-৭০ এ তিনবছর বাংলায় অনবরত খরা, বন্যা প্রভৃতি কারণে মারাত্মক ফসলহানি ঘটে। বাংলার ফসলহানি ঘটেছে, এ সংবাদ কোম্পানির কর্তৃপক্ষ পেলে তারা শঙ্কিত হয়ে সেনাবাহিনী, ইউরোপীয় ও কলকাতার অধিবাসীদের জন্য অবাধে চাল মজুত শুরু করে।
সরকারি মজুত নীতি দেখে ধনী লোক, ব্যবসায়ী, ফটাবাজ, মজুতদার সবাই যেখানে যা চাল পাওয়া যায় তা মজুত করতে থাকে। ফলে বাংলার চালের মূল্য বেড়ে যায়। = চালের মূল্য বেড়ে গেলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু নীতি অবলম্বন করার ফলে বাজার চালশূন্য হয়ে পড়ে।
৮. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি : কোম্পানির অন্যায়মূলক শাসননীতি ও মজুতদারি নীতির ফলে একদিকে যেমন চালের সংকট ও উচ্চদাম দেখা দেয়, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন- তেল, লবণ, ডাল প্রভৃতির দামও হুহু করে বেড়ে যেতে থাকে।
ফলে একসময় এসব দ্রব্যাদি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে মানুষের মধ্যে খাদ্য নিয়ে এক বিশাল হাহাকার জন্মলাভ করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ১১৭৬ এর মহাদুর্ভিক্ষ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পলাশির ভাগ্য বিপর্যয়ের পর বাংলার ভাগ্যাকাশে পরাধীনতার অমানিশা নেমে আসে। বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে দ্বৈত শাসনের মাধ্যমে বাংলার নবাবকে তাদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত করে।
কোম্পানি দেওয়ানির মুখোশ পরে দ্বৈত শাসনের দুর্ভোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এদেশের সামগ্রিক কর্তৃত্বের মালিক হয়।
আর এরূপ আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে কোম্পানি যেসব নীতি অবলম্বন করে তার পরিণতিতে ১৭৭০ সালে বাংলার বুকে নেমে আসেনিদারুণ দুর্যোগ, যা 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত।
তাই ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সাথে কোম্পানি ও তার কর্মচারী কর্তৃক গৃহীত নীতিকেই অধিকর দায়ী হিসেবে বিবেচনা করা যায়।