১৭৬৪ সালে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর
১৭৬৪ সালে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর |
১৭৬৪ সালে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর
- অথবা, বাংলার ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধের তাৎপর্য বর্ণনা কর।
- অথবা, বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : মীর জাফরের পদচ্যুতির পর ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর মীর কাসিম বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। মীর কাসিম ছিলেন মীর জাফরের জামাতা।
কিন্তু শ্বশুরের ন্যায় অযোগ্য ও অপদার্থ ছিলেন না। মীর কাসিম ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক।
সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি চুক্তি মোতাবেক ইংরেজদের পাওনা পরিশোধ করে তাদের নাগপাশ থেকে শাসন ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
কিন্তু তার এ সমস্ত পদক্ষেপসমূহ অচিরেই ইংরেজ কোম্পানির জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। পরিণামে ১৭৬৪ সালে কোম্পানির সঙ্গে মীর কাসিমের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হলে বাংলা দীর্ঘকালব্যাপী ইংরেজ শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। তাই বাংলার ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম।
বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব : যদিও পলাশির পরাজয়ে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হয়েছিল তথাপি বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে।
নিম্নে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
১. মীর কাসিমের পতন : ১৭৬০ সালে মীর জাফরের ক্ষমতাচ্যুতির পর মীর কাসিম বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু ১৭৬৪ সালে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটে।
বক্সারের যুদ্ধের ফলে মীরকাসিম সিংহাসনচ্যুত হন এবং মীর জাফর সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। নানারূপ শর্ত আরোপ করে মীর জাফরের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা হয়।
তার সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং তার দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি রাখা হয়। অন্যদিকে মীর কাসিম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করে । অবশেষে ১৭৭৭ সালে মীর কাসিমের মৃত্যু হয়।
২. ইংরেজ সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা : পলাশির যুদ্ধের চরম পরিণতি হলো ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধ। পলাশিতে যার সূচনা, বক্সারে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
পলাশির যুদ্ধ ছিল বড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার যুদ্ধ। সে কারণে ঐ যুদ্ধে ইংরেজ সামরিক শক্তির কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের সামরিক উৎকর্ষতার পরিচয় বহন করে।
এ যুদ্ধে ইংরেজরা শুধু মীর কাসিমকেই পরাজিত করেনি, বরং নিল্লির সম্রাট শাহ আলম এবং অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাকেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। ফলে ইংরেজ সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধি : বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয় শুধু নবাবি আমলেরই পরিসমাপ্তি ঘটায়নি, মুঘল সম্রাটের দুর্বলতা ও ইংরেজদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দ্রুতগতিতে ইংরেজদের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলা তথা ভারতবর্ষে কোম্পানির মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় এবং ভারতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়।
৪. সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিকাশ : ১৭৬৪ সালে মীর কাসিম ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিকাশ ঘটে।
এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ আধিপত্য বাংলা থেকে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী ইংরেজ আধিপত্যবাদের সূচনা হয়।
যার ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষে দুশো বছর ব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রোষানলে পতিত হয়ে পরাধীনতার নিগূঢ়ে আবদ্ধ হয়।
৫. কোম্পানির দেওয়ানি লাভ : ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এই অবস্থায় কোম্পানির সামনে দেওয়ানি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল गा সম্রাটের মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রদানের জন্য প্রস্তাব করে।
সম্রাট শাহ আলম বিনা বিধায় ক্লাইভের প্রস্তাবে রাজী হন এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট এক চুক্তিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদ অর্থাৎ রাজস্ব শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাতে অর্পণ করেন।
দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছলতা, বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ও রাজনৈতিক অধিপত্যের অধিকারী হয়।
কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রাথমিক পর্বের সমাপ্তি ঘটান। দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে কোম্পানি সত্যিকার অর্থে অর্থনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করে।
৬. দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন : বক্সারের যুদ্ধের পর একদিকে কোম্পানির প্রশাসনের শৃঙ্খলা আনয়ন, অপরদিকে বাংলা ও অযোধ্যার নবাব এবং মুঘল সম্রাটের সাথে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত স্থাপনের জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শাসন ব্যবস্থায় অভিনবত্ব কায়েম করে।
দেওয়ানি লাভের পর কী করে সবচেয়ে কম খরচে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করা যায় তার জন্য কোম্পানি দ্বৈত শাসনের কৌশল উদ্ভাবন করে।
এই ব্যবস্থা বাংলার নবাবের হাতে নিজামত শাসন ক্ষমতা আর কোম্পানির হাতে রাজস্ব শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। ক্ষমতার এরূপ বিভাজন থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা না থাকায় নবাব লাভ করেন ক্ষমতাহীন দারিত্ব।
পক্ষান্তরে রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির হাতে থাকায় কোম্পানি পায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এভাবে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের কল্যাণে কোম্পানি বাংলার অর্থনৈতিক ও শাসন ক্ষমতা দুই হস্তগত করে।
৭. কোম্পানির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ও রাজনৈতিক আধিপত্যের অধিকারী হয়।
আর এটা সম্ভব হয়েছিল বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির জয়লাভের কল্যাণে। কোম্পানি তার দেউলিয়া অবস্থা থেকে রক্ষা পায়।
দেওয়ানি লাভের পূর্বে ইংল্যান্ড থেকে যে বিপুল পরিমাণ পুঁজি ভারতে আনতে হত, তা দেওয়ানি লাভের পর বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যবসার সমস্ত পুঁজি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার উদ্বৃত্ত রাজস্ব থেকেই সংগৃহীত হয়।
দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানির আর্থিক স্বচ্ছলতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মোটকথা বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলার প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির হাতেই ন্যাস্ত হয়।
৮. মীর জাফরের উত্থান : ১৭৬০ সালে অযোগ্যতার অভিযোগে কোম্পানি মীর জাফরকে সরিয়ে মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিমকে সিংহাসনে বসান।
কিন্তু মীর কাসিম কোম্পানির স্বার্থের পক্ষে হানিকর হলে মীর কাসিমের সাথে কোম্পানির বিরোধ দেখা দেয়। যার পরিণতি ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধ।
বক্সারের যুদ্ধের ফলে মীর কাসিমের পতন ঘটে এবং মীর জাফর পুনরায় সিংহাসন অধিষ্ঠিত হয়। নানারূপ শর্তারোপ করে মীর জাফরকে পুতুল শাসকে পরিণত করা হয়।
তার সামরিক বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি উভয়ই ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়। ফলে মীর জাফর হয়ে পড়েন নামমাত্র শাসক।
৯. ১১৭৬-এর মন্বন্তর : বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে বাংলায় দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করে। এতে কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের লুণ্ঠন নীতি, বর্ধিত রাজস্ব চাপ এবং অনাবৃষ্টির ফলে শস্যহানি ঘটায় বাংলার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বাংলা ১১৭৬ সনে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
এ দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে মারাত্মক অবনতি ঘটে। এভাবে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয় বাংলায় এক মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন করে।
১০. দিল্লি ও অযোধ্যার পরাজয় : ১৭৬৪ সালের বক্সারের | যুদ্ধে মীর কাসিমের সঙ্গে দিল্লির সম্রাট শাহ আলম এবং অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাও যোগদান করে।
১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই তিন সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বক্সারে মুখোমুখি হয়। এ যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি মনরো সম্মিলিত বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন।
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ আলম তৎক্ষণাৎ ইংরেজ পক্ষে যোগদান করেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে আশ্রয় নেন। এভাবে বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতীয় শক্তির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের দিক দিয়ে বিচার করলে মীর কাসিমের সহিত ইংরেজদের সংঘটিত সংঘর্ষ বিশেষ করে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত সর্বশেষ বক্সারের যুদ্ধ পলাশির যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ ছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে J. Stephen-এর মত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “Buxar deserves for more than plassey to be considered as the origin of the British power in India." এ যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শক্তিকে আর নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ করতে হয়নি।
পরবর্তী যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ। মোটকথা বক্সারের যুদ্ধ ছিল ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের চূড়ান্ত পরিণতি। এজন্য বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে বক্সারের যুদ্ধ ছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।