শেরশাহের শাসন সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর
সংস্কারক হিসেবে শেরশাহের অবদানসমূহ মূল্যায়ন কর |
সংস্কারক হিসেবে শেরশাহের অবদানসমূহ মূল্যায়ন কর
- অথবা, শেরশাহের বিভিন্ন সংস্কার মূল্যায়ন কর।
- অথবা, রাজ্য পরিচালনায় শেরশাহ যেসব সংস্কার সাধন করেন তা বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : শেরশাহ মুঘল সাম্রাজ্যের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও মানবতার গুণে গুণান্বিত ছিলেন।
তিনি ১৫৪০ সালে সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন মানবদরদি, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক।
তিনি আরো ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাবী ও সাহসী। তাই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেন।
→ শেরশাহের সংস্কারসমূহ : শেরশাহ ক্ষমতা গ্রহণ করে নানাবিধ সংস্কার লক্ষ করেন। নিম্নে শেরশাহের সংস্কারসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি : শেরশাহের শাসন নীতি স্বৈরাচারমূলক ছিল বটে কিন্তু তার উদ্দেশ্য প্রজা নিপীড়ন নয়। বরং তা ছিল জনকল্যাণমুখী। এককেন্দ্রিক জনকল্যাণমুখী ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ছিল তার শাসনতন্ত্রের মূলনীতি।
হিন্দু ও মুসলিম শাসন পদ্ধতি এবং হিন্দু-মুসলিম জনগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন তার শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল।
পরবর্তীতে আকবর যেমন সকল শ্রেণির জনগণের মনোরঞ্জনের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, শেরশাহও তেমনি জনগণের সদিচ্ছার উপর যথেষ্ট জোর দিয়েছিলেন।
২. কেন্দ্রীয় প্রশাসন পুনর্গঠন : রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শেরশাহ তার কেন্দ্রীয় প্রশাসনে ৪ জন মন্ত্রী ও ৪ জন পদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। ৪টি মন্ত্রণালয়ের নাম ও তার কাজ নিম্নরূপ :
(ক) নিউয়ান-ই-গুজারাত : নিউয়ান-ই-ওজারাত ছিল শেরশাহের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য একটি মন্ত্রণালয়। এটি ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান ছিলেন ওয়াজির।
এ বিভাগের কাজ ছিল রাজ্যের আয়-বানোর হিসেব সংরক্ষণ করা। উজির কয়েকজন সহকারী নিয়ে তার দায়িত্ব পালন করতেন।
(খ) নিউয়ান-ই-আরজ : দিউয়ান-ই-আরজ ছিল শেরশাহের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এটি ছিল সামরিক বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিভাগের প্রধানকে বলা হতো আরিফ-ই-মামালিক। তিনি সৈন্য সংগ্রহ, সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা, তাদের বেতন ও শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি তত্ত্বাবধান করতেন।
(গ) নিউয়ান-ই-রিসালাত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : এ বিভাগের কাজ ছিল বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করা। এ বিভাগের প্রধান ছিলেন একজন বৈদেশিক মন্ত্রী। যিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং বিদেশে থেকে আগত দূতদের অভ্যর্থনা জানাতেন।
(ঘ) নিউয়ান-ই-ইনশা : যোগাযোগ ব্যবস্থায় তার যথে অবদান ছিল। এ নিউয়ান-ই-ইনশা ছিল মূলত যো এ বিভাগের একজন মন্ত্রী ছিলেন যিনি রাজকীয় বার্তা ও ঘোষণা রচনা করতেন।
প্রাদেশিক প্রশাসক ও অন্যা কর্মকর্তাদের সাথে এ বিভাগের মন্ত্রী মত বিনিময় করতেন এবং সরকারি দলিল দস্তাবেজে সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
৩. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা : শেরশাহ সুষ্ঠুভাবে শাসনক পরিচালনার জন্য সমগ্র সাম্রাজ্যেকে ৪৭টি সরকারে বিভক্ত করেন। এবং প্রত্যেকটি সরকারকে কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেন।
প্রত্যেক সরকারে শিকদার-ই শিকদারান ও মুন্সেফ-ই-মুনসিকার নামে দুজন উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। যারা পরগনার শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেডেন।
৪. রাজস্ব নীতি : শেরশাহ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত। করার জন্য নতুন করে ভূমি জরিপ এবং রাজস্ব নির্ধারণ করেন। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি দেশে সকল জমি জরিপ করেন এবং উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ এবং এক-চতুর্থাংশ রাজস্ব ধার্য করেন।
৫. রাজস্ব আদায় : শেরশাহ রাজস্ব আদায়ের মুকাদ্দাস, চৌধুরী, পাটোয়ারি প্রভৃতি কর্মচারীদের নিয়োগ করেছিলেন। যারা উৎপাদিত পণ্য অথবা নগদ অর্থের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতো।
তবে শেরশাহের শাসনামলে রাজ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা প্রদর্শন করা হলেও রাজগ আদায়ে কঠোরতা প্রদর্শন করা হতো।
৬. কবুলিয়ত ও পাট্টা : শেরশাহ ভূস্বামী প্রথার মূলোৎপাটন করে কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কবুলিয়ত হলে কৃষকগণ জমির উপর তাদের অধিকার ও দায়িত্ব বর্ণনা করে সরকারকে দেওয়া অঙ্গীকার নামা। আর পাট্টা হলো সরকার কর্তৃক জমির উপর কৃষকদের স্বত্ত্ব স্বীকার করে প্রদত্ত স্বীকৃতি পত্র।
৭. মুদ্রাব্যবস্থা: শেরশাহ : ১৬৫, ১৬৬ ও ১৬৭ মেন ওজনের স্বর্ণমুদ্রা; এক-দ্বিতীয়াংশ, এক-চতুর্থাংশ, এক-অষ্টমাংশ এবং এক-ষোড়শাংশ মানের রৌপ্য মুদ্রা এবং তাম্রমুদ্রা প্রচলন করেন।
ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড বলেন, “শেরশাহের মুদ্রা সংস্কার ভারতী মুদ্রাব্যবস্থার ইতিহাসে মূল্যবান সম্পদ।” তিনি স্বর্ণমুদ্রা সহ আধুলি, সিকি, দুই আনি ইত্যাদি খুচরা মুদ্রার প্রবর্তন করেন।
৮. শুল্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য : জনগণের স্বার্থরক্ষার্থে শেরশা অভ্যন্তরীণ শুল্ক অফিস উঠিয়ে দেন। তিনি আদেশ দেন যে, বিদেশি পণ্য দ্রব্য থেকে সীমান্তে এবং বিক্রয় কেন্দ্রে উভয় জগতেই আদায় করতে হবে। বাণিজ্য শুল্কের পরিমাণ ছিল আড়াই শতাংশ।
৯. সামরিক সংস্কার : সিংহাসনে আরোহণ করে শেরশহ জায়গির প্রথা বিলুপ্ত করে বেতনভোগী সৈন্য নিয়োগ প্রথার প্রচলন করেন।
সৈন্যদের দুর্নীতি ও অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জন প্রতিরোধের জন্য তিনি আলাউদ্দিন খলজির নীতি অনুসারে সৈন্যবাহিনীতে 'দাগ' ও 'চেরা' ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
১০. পুলিশ ও গুপ্তচর : শেরশাহের সংস্কারের মধ্যে পুলিশ ও গুপ্তচর ছিল অন্যতম। যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে শেরশাহ একটি সুদক্ষ ও শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলেন এবং বলবন ও আলাউদ্দিন খলজির নীতি অনুসরণ করেন।
আলাউদ্দিন খলজির নীতি অনুসারে তিনিও সাম্রাজ্যব্যাপী গুপ্তচর প্রথার প্রচলন করেন। সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংবাদ গুপ্তচরের মাধ্যমে অবগত হয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেন।
ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “শেরশাহের পুলিশি ব্যবস্থা সুলতানি হলেও উন্নত ধরনের এবং শক্তিশালী ছিল।”
তিনি পুলিশবাহিনীকে গ্রাম পুলিশ ও শহুরে পুলিশ এ দুই ভাগে ভাগ করেন। স্থানীয় চুরি, ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধের জন্য গ্রাম প্রধানগণ দায়ী থাকতেন।
১১. যোগাযোগ ব্যবস্থা : শেরশাহের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল উল্লেখযোগ্য সংস্কার । সেনাবাহিনীর দ্রুত যাতায়াত নিশ্চিত করা, জনগণের চলাচল এবং ডাক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য শেরশাহ অনেকগুলো রাস্তা নির্মাণ করেন। তার নির্মিত রাস্তার মধ্যে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছিল উল্লেখযোগ্য
১২. ডাক বিভাগ : শেরশাহের একটি যুগান্তকারী বিভাগ হলো ডাক বিভাগ। তার ডাক বিভাগ সরাইখানাগুলো ডাকচৌকি হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
ডাকচৌকির প্রধানকে দারোগা-ই- ডাকচৌকি বলা হতো। রাষ্ট্রের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুতসংবাদ বহনের জন্য শেরশাহ ঘোড়ার ডাকের ব্যবস্থা চালু করেন।
১৩. বিচারব্যবস্থা : শেরশাহ বিচারব্যবস্থাতেও পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি বিচার ব্যবস্থাকে নবদিগন্তের সূচনা করেন। “All are equal in the eye of law." সুবিচারের জন্য শেরশাহের খ্যাতি ছিল সর্বজন স্বীকৃত।
ঐতিহাসিক মোহার আলী বলেন, "Shershah was the terrible lion of justice." দার আল আদালত নামক বিচারালয়ে কাজি ও মির-ই-আদালত বিচার কার্য সম্পন্ন করতেন।
শেরশাহ প্রতি বুধবার বিকেলে আপিল শুনতেন। হিন্দু, মুসলিম উভয়ের জন্য একই ফৌজদারি আইন থাকলেও দেওয়ানি আইন ছিল ভিন্ন ভিন্ন। গ্রামাঞ্চলের শাসন ও বিচারকার্য পঞ্চায়েত ও গ্রাম্য মোড়লদের দ্বারা পরিচালিত হতো।
১৪. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা : শেরশাহ জনকল্যাণমূলক অনেক কার্যাবলি সম্পাদন করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি ও জোতদারদের অত্যাচারে ফসলের ক্ষতি হলে তিনি রাজস্ব মওকুফ ও কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতেন।
তিনি আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতির সম্প্রসারণ যুগোপযোগী করেন। এসব সংস্কারমূলক উদ্যোগ তার রাষ্ট্রের উন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল ।
১৫. খান-ই-সামান : রাজকীয় গৃহস্থালি কাজের তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ করার জন্য এ আমলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি বড় দপ্তর হলো খান-ই-সামান।
এ বিভাগে একজন গৃহকর্মী এবং বহুসংখ্যক কর্মচারীসহ অসংখ্য খাদেম ও পাচকপাচিকা নিযুক্ত থাকতো। গৃহাধ্যক্ষ, রন্ধনশালা, মেহমানদের আপ্যায়ন, অভ্যর্থনা এবং অবস্থানের বন্দোবস্ত করতেন।
১৬. শিক্ষা সংস্কার : শেরশাহ শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি শিক্ষা সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন।
শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তার সময় আরবি শিক্ষা, ফারসি ও ধর্মীয় শিক্ষা যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় ।
১৭. ভূমি জরিপ : রাজস্ব সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে শেরশাহ দিল্লির মসনদে আরোহণ করেই রাজস্বব্যবস্থা সংস্কার সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাই তিনি ভূমি জরিপ করেন। তিনি ভূমি জরিপ করে স্থানীয় রাজকর্মচারীদের খাজনা আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধার্থে তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যের আবাদি ও অনাবাদি জমির পরিমাণ নির্ধারণের ব্যবস্থা করেন। তাই ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “যে মুসলিম শাসক সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন তিনি হলেন শেরশাহ।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দিল্লির ইতিহাসে শেরশাহ ছিলেন এক স্বনামধন্য ও শক্তিশালী শাসক। তার সংস্কারাবলির দিকে লক্ষ রেখে ঐতিহাসিক কীনি বলেন, “কোনো শাসক এমনকি ব্রিটিশ সরকারও এ পাঠানের ন্যায় শাসনকার্যে এত বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেননি।”
প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস করে শেরশাহ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আকবরের পূর্বে যেকোনো যুবরাজের তুলনায় শেরশাহ তার প্রজাদের অভিভাবক ও আইন প্রণেতা হিসেবে অধিক মর্যাদা লাভ করেন। তার শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক হলেও দক্ষ, প্রগতিশীল এবং জনকল্যাণকর ছিল।