শেরশাহের উত্থান আলোচনা কর
শেরশাহের উত্থান আলোচনা কর |
শেরশাহের উত্থান আলোচনা কর
- অথবা, শেরশাহের ক্ষমতা গ্রহণের বর্ণনা দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : শেরশাহ মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়ে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করছিল।
তারা মনেপ্রাণে চাইছিল মুঘলদের পরাজিত করে হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে। ঠিক সে সময়ে শেরশাহ আফগানদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
শেরশাহ ছিল অদম্য মেধাবী ও সফল সমরনায়ক। তার জীবনে নানা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
→ শেরশাহের উত্থান : শেরশাহ তার জীবনের শুরু থেকেই বিভিন্ন অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠেন। নিম্নে শেরশাহের উত্থান আলোচনা করা হলো :
১. পিতার জায়গিরের দায়িত্ব গ্রহণ : শেরশাহের জীবনে অভ্যুত্থান শুরু হয় ১৫১৮ সালে পিতার এলাকা সাসারামের জায়গীর হওয়ার মধ্যদিয়ে। ছোটবেলা থেকে নানা দুঃখ কষ্টের মধ্যদিয়ে জীবন কাটালেও পিতার খানিকটা সদয় দৃষ্টির কারণে শেরশাহ জায়গিরের দায়িত্ব পান।
তিনি এ সময় জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করেন এবং কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। তবে এ জায়গীরের দায়িত্ব শেরশাহের উপর মাত্র ৫ বছর ছিল।
২. ইব্রাহীম লোদীর অধীনে চাকরি গ্রহণ : বিমাতার ষড়যন্ত্রের কারণে শেরশাহ পিতার জায়গিরের পদ হারান। এ সময় শেরশাহ ভাগ্যান্বেষণে আগ্রায় চলে যান এবং দিল্লির সুলতান ইব্রাহীম লোদীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।
এরই মধ্যে শেরশাহের পিতার মৃত্যু হলে ইব্রাহীম লোদীর ফরমানে পুনরায় তিনি সাসারামের জায়গির হন। তবে এবারও তিনি বেশিদিন টিকতে পারেননি।
৩. বাহার খানের অধীনে চাকরি গ্রহণ : আবারও বিমাতা ও সৎভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হলে শেরশাহ পুনরায় সাসারাম ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বিহারের স্বাধীন সুলতান বাহার খান লোহানীর অধীনে চাকরিগ্রহণ করেন।
১৫২২ থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত শেরশাহ বাহার খানের অধীনে চাকরি করেন এবং শাসনকার্যের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মূলত এ সময়ই শেরশাহের প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
এ সময় তিনি বাহার খানের। সহকারি ও তার পুরের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এখানেও তিনি বেশিদিন টিকতে পারেননি।
৪. বাবরের অধীনে চাকরি গ্রহণ : বাহার খানের কাছ থেকে হলে শেরশাহ ১৫২৭ সালে আমায় চলে যান এবং মুঘল সম্রাট বাবরের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।
তিনি ১৪ মাস বাবরের অধীনে চাকরি করেন। এ সময় শেরশাহ চান্দেরী দুর্গ করে বাবরকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করেন এবং এর পুরস্কারস্বরূপ পুনরায় সাসারামের জায়গির পদ ফিরে পান।
৫. বিহারে প্রত্যাবর্তন : ইতোমধ্যে বিহারের শাসক বাহার খানের মৃত্যু হলে শেরশাহ পুনরায় বিহারে ফিরে আসেন এবং বাহার খানের শিশুপুত্রের অভিভাবক নিযুক্ত হন।
এ সময় শেরশাহ অনেক ক্ষমতা লাভ করেন এবং বিহারের ভাগ্যবিধাতা হন। এ সময় শোহ্ আফগানদের সুসংঘবদ্ধ করার প্রয়াস পান।
৬. হুমায়ূনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব : ১৫৩০ সালে শেরশাহ চুনার দুর্গের অধিপতি তাজখানের বিধবা পত্নী মালিকা বানুকে বিবাহ করেন এবং এতে চুনার দুর্গটি শেরশাহের অধীনে চলে আসে।
মুঘল সম্রাট হুমায়ূন শেরশাহের এ শক্তি বৃদ্ধির খবর পেয়ে ১৫৩১ সালে সুন্দর দুর্গে শেরশাহকে অবরোধ করেন। সুচতুর শেরশাহ হুমায়ূনের প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রকাশ করে অবরোধ তুলে নেন।
৭. সুরজগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ : শেরশাহের শক্তি বৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে বিহারের অধিপতি জালাল শাহ ও বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ সম্মিলিতভাবে শেরশাহকে দমন করার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
১৫৩৪ সালে সুরজগড়ের যুদ্ধে শেরশাহ বাংলা ও বিহারের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে শেরশাহের প্রস্তাব প্রতিপত্তি আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
৮. বাংলা আক্রমণ : ১৫৩৬ সালে শেরশাহ সৈন্যে বাংলা আক্রমণ করেন। এ সময় তিনি বাংলার শাসক মাহমুদ শাহের কাছ থেকে অনেক অর্থ আদায় করে চুনার দুর্গে ফিরে যান। পরের বছর ১৫৩৭ সালে শেরশাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। এবং গৌড় জয় করেন।
৯. বারানসি, রোটাস ও জৌনপুর অধিকার : শেরশাহের বাংলা আক্রমণের খবর পেয়ে হুমায়ূন শেরশাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং চুনার দুর্গ অবরোধ করেন।
এ সময় কৌশলী শেরশাহ হুমায়ুনের সাথে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে গৌড় ত্যাগ করেন এবং এ সময় শেরশাহ বারানসি, রোটাস, জৌনপুর অধিকার করে নেন। এবং কনৌজ পর্যন্ত আসর হন।
১০. চৌদার যুদ্ধে জয়লাভ : শেরশাহ যখন রোটাস, জৌনপুর প্রভৃতি জায়গা দখল করেন সে সময় হুমায়ুন গৌড়ে অবস্থান করেন। শেরশাহ হুমায়ূনের বাংলা থেকে বের হওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করে দেন।
হুমায়ূন বিপদ বুঝতে পেরে সদলবলে বাংলা ত্যাগ করে আমায় ফিরে যেতে চাইলে শেরশাহ তাকে বাধা প্রদান করে।
১৫৩৯ সালের ২৬ জুন বক্সারের নিকটবর্তী গঙ্গা নদীর তীরে চৌসা নামক স্থানে হুমায়ূন ও শেরশাহের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শেরশাহ জয়লাভ করেন।
১১. বিলগ্রামের যুদ্ধে জয়লাভ : চৌসার যুদ্ধে জয়লাভ করার পর শেরশাহের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং তিনি দিল্লি জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
অন্যদিকে হুমায়ূন তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য পুনরায় সৈন্য সপ্তাহ করে নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।
পরের বছর ১৫৪০ সালের ১৭ মে হুমায়ূন প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে কনৌজ প্রান্তরে বিলগ্রাম নামক স্থানে শেরশাহের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হুমায়ূন প্রাণপণ যুদ্ধ করলেও দুর্ভাগ্যবশত এ যুদ্ধেও তিনি পরাজিত হন।
এ যুদ্ধে হুমায়ূনের পরাজয়ের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এব হুমায়ূন ফেরারী হয়ে দেশ বিদেশে ঘুরতে থাকেন। ভারতবর্ষে পুনরায় আফগান প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শেরশাহ ছিলেন। অসামান্য প্রতিভাবান একজন ব্যক্তি। তিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
যা ছিল যেকোনো শাসকের জন্য আদর্শ। তিনি সামান্য অবস্থা থেকে বিভিন্ন পথপরিক্রমায় আফগান দলপতি নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে শুর শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।