শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে ধারণা দাও
শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে ধারণা দাও |
শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার সম্পর্কে ধারণা দাও
- অথবা, শেরশাহের তুমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
উত্তর : ভূমিকা : "He was in truth one of the greatest rulers who ever sat upon the throne of Delhi" শেরশাহ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক ধ্রুবতারা।
তিনি ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন আফগান শুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার বিবিধ সংস্কারগুলোর মধ্যে রাজস্ব সংস্কার অন্যতম।
→ শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার : স্তর বংশের প্রতিষ্ঠাতা শেরশাহ বিল্লির মসনদে আরোহণ করেই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
নিম্নে তার রাজস্ব সংস্কার ও সাফল্য বর্ণনা করা হলো :
১. ভূমি জরিপ : রাজস্ব সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে শেরশাহ দিল্লির মসনদে আরোহণ করেই রাজস্বব্যবস্থা সংস্কার সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তাই তিনি ভূমি জরিপ করেন। তিনি ভূমি জরিপ করে স্থানীয় রাজকর্মচারীদের খাজনা আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
২. খাজনা নির্ধারণ : ভূমি জরিপের মাধ্যমে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বিবেচনা করে তিনি জমিকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। যথা-
(ক) উৎকৃষ্ট,
(খ) মধ্যম ও
(গ) নিকৃষ্ট।
ভূমির ধরন অনুসারে ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ হিসেবে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। উৎপাদিত ফসলের উপর খাজনা নির্ধারিত হওয়ায় কৃষককূল অত্যাচারিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
৩. খাজনার পরিমাণ : শেরশাহ জমির খাজনার পরিমাণ নির্ধারণের এক অভিনব পদ্ধতি চালু করেন। তার রাজস্ব ব্যবস্থায় নিম্নোক্ত হারে জমির খাজনা নির্ধারণ করা হতো-
(ক) এক বিঘা উৎকৃষ্টমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ১৮ মণ
(খ) এক বিঘা মধ্যমমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ১২ মণ
(গ) এক বিঘা নিকৃষ্টমানের জমিতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ধরা হতো ৮ মণ ৫ সের।
৪. রায়তওয়ারি ব্যবস্থা : শেরশাহের ভূমি রাজস্বব্যবস্থায় রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু ছিল। তিনি এ বায়তওয়ারি ব্যবস্থার জায়গায় সরাসরি কৃষকদের সাথে ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত করেন। তবে মালব, রাজস্থান ও মুলতানে তিনি জায়গিরদারি ব্যবস্থা বহাল রাখেন।
৫. কবুলিয়ত ব্যবস্থা : রাজস্ব সংস্কার সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শেরশাহ কবুলিয়ত বা অঙ্গীকারপত্র দ্বারা অঙ্গীকার করানোর ব্যবস্থা চালু করেন। এ দুটি শর্তপত্রে সরকার ও কৃষকদের দেনাপাওনার কথা উল্লেখ থাকত।
ভূমিতে কৃষকদের অধিকারের জন্য যে দলিল প্রদান করা হতো তাকে বলা হতো পাট্টা। আর রাজস্ব প্রদানের জন্য যে অঙ্গীকারনামা কৃষকরা প্রদান করতো তাকে বলা হয় কবুলিয়ত ।
৬. সর্বত্র জরিপ একই রকম : শেরশাহের সময় সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই ধরনের জমির মাপ চালু করা হয়। এ জমি মাপার নাম ছিল সিকান্দারি পাজি।
৭. রাজস্ব আসায় ব্যবস্থার সংস্কার : শেরশাহ রাজস্ব আদায়ের জন্য মুকাদ্দাস, চৌধুরী, পাটোয়ারি নামক কর্মচারী নিয়োগ করেন। প্রজারা ইচ্ছা করলে সরাসরি রাজকোষে রাজস্ব জমা দিতে পারত।
রাজস্ব হিসেবে নগদ অর্থ কিংবা শস্য গ্রহণ করা হতো। নির্ধারিত সময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্য কর্মচারীদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল। রাজস্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন করা হলেও আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার উদারতা দেখানো হতো না।
তবে প্রজাবৎসল শেরশাহ ফসলের ক্ষতি, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির কারণে কৃষকদের খাজনা মওকুফ করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি তাদের কৃষি ঋণও প্রদান করতেন।
৮. শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার : শেরশাহ রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য শুল্ক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। রাজ্যের সর্বত্র চালু বিভিন্ন ধরনের অবৈধ শুল্ক বাতিল করে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনিই একমাত্র শাসক যিনি সীমান্তে বিক্রয় শুল্ক ধার্য করার নীতি প্রচলন করেন।
৯. পাটা ব্যবস্থার প্রচলন : তিনি অনেক সংস্কার করে তার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি যেসব সংস্কার করেন তার মধ্যে পাট্টা প্রথা অন্যতম।
তিনি ভূস্বামী প্রথার মূলোৎপাটন করে পাট্টা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পাট্টা হলো সরকার কর্তৃক জমির উপর কৃষকদের স্বত্ত্ব স্বীকার করে প্রদত্ত স্বীকৃতিপত্র।
১০. মুদ্রাব্যবস্থার সংস্কার : মুদ্রাব্যবস্থার সংস্কার শেরশাহের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। তিনি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মুদ্রাব্যবস্থা সংস্কার করেন।
তিনি উপলব্ধি করেন যে, রাজ্যে বিভিন্ন মুদ্রার প্রচলন থাকলে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
তাই তিনি মুদ্রা ব্যবস্থার জটিলতা দূর করার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রা বাতিল করে দাম নামক এক অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা চালু করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শেরশাহ একজন বিবেকবান ও সব্যসাচী সম্রাট। তিনি প্রজানের যাবতীয় বিষয় নিয়ে ভাবতেন।
তিনি কল্যাণের পূজারী। তার বাস্তব সম্মত, গণমুখী ও সময়োপযোগী রাজস্বনীতি তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করে।
যোগ্যতা ও মেধার বলে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের এক সফল প্রজারঞ্জক। তাই বলা যায়, দিল্লির ইতিহাসে শেরশাহ ছিলেন এক স্বনামধন্য ও শক্তিশালী শাসক।