শেরশাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর
শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর |
শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা কর
- অথবা, শেরশাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
- অথবা, শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব বর্ণনা কর
উত্তর : ভূমিকা : ভারতবর্ষের শাসকদের ইতিহাসে শেরশাহ ছিলেন অন্যতম। বিশেষ করে তার মেধা, বুদ্ধি ও প্রশাসন পরিচালনার অসামান্য দক্ষতা শেরশাহকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে।
শেরশাহের প্রাথমিক জীবন ছিল নানা রকম প্রতিকূলতায় ভরা। যার ফলে শেরশাহ ছোটবেলা থেকেই প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারত। অতি সামান্য অবস্থা থেকে শেরশাহ। | নিজ মেধা ও বুদ্ধি দ্বারা নিজেকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন।
→ শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব : শেরশাহ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একজন সার্বভৌম শক্তিশালী শাসকের সকল চারিত্রিক গুণ তার মধ্যে ছিল। নিম্নে শেরশাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো।
১. বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী : শেরশাহ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বাল্যকালেই তার প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তিনি যেকোনো বিষয় সম্বন্ধে খুব সহজেই জ্ঞান লাভ করতেন।
যুবক বয়সে জায়গিরদারের দায়িত্ব পালনকালে শেরশাহ বেশ সাফল্য প্রদর্শন করেন। শেরশাহ নিজ প্রতিভাবলে বিভিন্ন শাসকের অধীনে চাকরি করতেন এবং সাফল্য লাভ করেন। তার এ বহুমুখী প্রতিভার কারণে ভারতের ভাগ্যাকাশে হঠাৎ করেই তার উদয় ঘটে।
২. সুচতুর যোদ্ধা ও রণপরিকল্পনাবিদ : শেরশাহ ছিলেন সুচতুর যোদ্ধা এবং তার রণপরিকল্পনা ছিল অনেক উন্নত। তিনি তার জীবনে পরিচালিত কোনো যুদ্ধে হারেননি।
তার সুনিপুণ রণপরিকল্পনার কারণে তিনি অল্প কিছু সৈন্য নিয়েও বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করেন। চৌসার যুদ্ধে ও বিলগ্রামের যুদ্ধেও শেরশাহ উন্নত রণকৌশল ও রণপরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি হুমায়ূনের দুর্বলতা ও ভুলগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেন এবং সে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যান এবং চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেন।
৩. কূটকৌশলী : শেরশাহ একদিকে যেমন ছিলেন সুনিপুণ যোদ্ধা অন্যদিকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কূটকৌশলী। হুমায়ূন যখন গৌড়ের দিকে তার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে তখন শেরশাহ হুমায়ূনের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।
এমনকি প্রথমদিকে তিনি হুমায়ূনের প্রতি মৌখিক আনুগত্যও প্রদর্শন করেননি। প্রকৃতপক্ষে এগুলো ছিল তার কূটকৌশল। রাজপুত্রদের সাথে যুদ্ধে বিশেষ করে রায়সিন দুর্গ অধিকারের সময় শেরশাহ সামরিক কূটকৌশল অবলম্বন করেন।
৪. দক্ষ শাসক : শেরশাহ শুধুমাত্র বীর যোদ্ধা ও রণকৌশলীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। স্বল্পকালীন শাসনামলে শেরশাহ ভারতবর্ষে একটি সুশাসিত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বিভিন্ন রাজ্যগুলোকে দিল্লির শাসনাধীনে এনে সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান করেন এবং কেন্দ্রীয় শাসনকে উন্নত করেন। তাছাড়া প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক প্রশাসনেও শেরশাহ বেশ কিছু সংস্কার সাধন করে শাসনব্যবস্থাকে সুসংঘবন্ধ করেন।
৫. বিজ্ঞানমনস্কের অধিকারী : শেরশাহ ছিলেন বিজ্ঞান মনস্কের অধিকারী। তিনি সকল যুদ্ধে উন্নত বৈজ্ঞানিক অস্ত্রসস্ত্র ব্যবহার করেন।
ভূমি রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার, শুষ্ক ও মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার, সামরিক ও পুলিশ বিভাগ পর্যালোচনা করলেই শেরশাহের বিজ্ঞানমনস্কের পরিচয় পাওয়া যায়।
৬. প্রজাহিতৈষী শাসক : শেরশাহ স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হলেও কখনই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রজাহিতৈষী প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটান।
তিনি প্রজাদের কল্যাণে বহু রাস্তা ও সরাইখানা নির্মাণ করেন। উন্নত মুদ্রার প্রচলন, ঘোড়ার ডাক চালু পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনানিবাস স্থাপন তার প্রজাহিতৈষিতার পরিচয় বহন করে।
৭. দায়িত্বশীল শাসক : শেরশাহ ছিলেন একজন দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ শাসক। শাসক হিসেবে তার নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে শেরশাহ সচেতন ছিলেন।
তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র ও প্রজার কল্যাণ সাধন করাই একজন শাসকের প্রধান দায়িত্ব। শেরশাহ রাজ্যের প্রতিটি বিষয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। গুপ্তচর প্রথার মাধ্যমে রাজ্যের সকল খোঁজখবর নিতেন।
৮. ধর্মনিরপেক্ষ : শেরশাহ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ উদারনৈতিক শাসক। তিনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করেন এবং জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি হিন্দুদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কেননা তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে ছাড়া রাজ্যের প্রকৃত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা কখনই সম্ভব নয়।
তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককে রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেন।
৯. শিল্প ও সাহিত্যমনা : শেরশাহ ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যমনা শাসক। তিনি নিজে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ অনুরাপ ছিল। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তিদেরকে সমাদর করতেন।
তার শাসনামলে প্রতিটি সরলাতে একটি করে দুর্গ নির্মিত হয়। নিল্লির কেন্দ্রা মসজিদ ও সাসারামে হ্রদের ধারে তার সমাধিসৌধ তার স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে।
১০. সংস্কৃতির সমন্বয় : শেরশাহ ছিলেন সংস্কৃতির সমন্বয় সাধক। তার সময়ে মুসলমানরা হিন্দিতে সাহিত্য রচনা শুরু করে। তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। দিল্লিতে নির্মিত শেরশাহের কেল্লা ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শেরশাহ ছিলেন অসামান্য জ্ঞানের ও চরিত্রের অধিকারী এবং সুশাসক। তার চরিত্রের মধ্যে আইনের অনুশাসন সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
তার সুশাসনের ফলে তার শাসনামলে তার রাজ্যের লোকেরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাত। তিনি সামান্য অবস্থা থেকে শুর শাসন প্রতিষ্ঠা ও ভারতের শাসনসংস্কার করে ভারতের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেন ।