সম্রাট আকবরের সাফল্যের মূল কারণসমূহ চিহ্নিত কর
সম্রাট আকবরের সাফল্যের মূল কারণসমূহ চিহ্নিত কর |
সম্রাট আকবরের সাফল্যের মূল কারণসমূহ চিহ্নিত কর
উত্তর : ভূমিকা : সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের সামগ্রিক ইতিহাসে অন্যতম কৃতী পুরুষ। হিমালয় হতে কৃষ্ণানদী এবং হিন্দুকুশ হতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট আকবর একজন সফল ব্যক্তি ছিলেন।
সর্বগুণের আধার আকবর শুধু ইতিহাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়কই ছিলেন না, বরং সমকালীন ইতিহাস তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
আকবর অক্লান্ত যুদ্ধাভিযান, দূরদর্শী, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, নিগূঢ় ধর্মপ্রবণতা, প্রজাহিতৈষী শাসন সার্বজনীন সহিষ্ণুতা, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।
- সম্রাট আকবরের সাফল্যের মূল কারণ : সম্রাট আকবরের সাফলো মূল কারণসমূহ নিম্নে পেশ করা হলো :
১. বৈরাম খানের অভিভাবকত্ব : সিংহাসনারোহণ ১৫৫৬ সালে পিতা হুমায়ূনের মৃত্যুর পর ১৩ বছর বয়সে আকবর পিতার বিশ্বস্ত বন্ধু, সহচর ও নিম্ন শিক্ষক বৈরাম খানের অভিভাবকত্বে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
২. দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আকবরের সফলতা : আকবরের ক্ষমতা লাভের সাথে সাথে আদিল শাহ শূরের হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হিমু বিশাল বাহিনী নিয়ে দিল্লি ও আগ্রা অভিমুখে অভিযান করলে আকবর ও বৈরাম খান পানিপথের ঐতিহাসিক প্রান্তরে হিমুকে প্রতিরোধ করেন।
প্রতিরোধ যুদ্ধের হিমু পরাজিত ও নিহত হন। ফলে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তারে মুঘল-আফগান সংঘর্ষের অবসানই হয়নি।
বরং হিন্দুদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ধূলিসাৎ হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত সূচনা ও এর সম্প্রসারণের পথ প্রশস্ত হয়। বৈরাম খানের সহযোগিতায় ১৫৫৬-৬০ সালের মধ্যে আকবর গোয়ালিয়র, আজমির এবং জৌনপুর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
৩. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি : মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সম্রাট আকবর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি গ্রহণ করেন। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে আকবর উপজাতীয়দের বিদ্রোহ দমন করে ১৫৯৫ সালে কান্দাহার মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. দাক্ষিণাত্য নীতি : ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “কান্দাহার বিজয় আকবরের কূটনৈতিক মেধার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।" ১৫৯৫ সালের মধ্যে কান্দাহার হতে বাংলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উত্তর ভারতের ভূখণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করে আকবর বিচক্ষণ ভারতে অভিযান করার আয়োজন করেন।
সাম্রাজ্যবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিন্ধ্যা পর্বতের লক্ষিণে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। পাক্ষিণাত্যে অভিযানের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য ধর্মনা থেকে কৃষ্ণনদী পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
৫. আকবরের রাজপুত নীতি : সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে তার রাজপুত নীতি আলোচনা করা হলো:
(ক) সহনশীল মনোভাব : সম্রাট আকবর মুঘল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপুতদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করেন। ভারতবর্ষে হিন্দু জাগরণে নেতৃত্ব দান করেন রণদক্ষ ও নির্ভীক রাজপুত অধিপতিগণ।
মুঘলদের আক্রমণে তারাই অধিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাই আকবর কৌশলে রাজপুত জানি সম্রষ্টি ও শুভেচ্ছা কামনার্থে তাদেরকে রাজকার্যে নিযুক্ত করেন।
(খ) বিভিন্ন সংস্কার : হিন্দুদের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি লাভের জন্য আকবরের পূর্ববর্তী নীতি পরিবর্তন করে বিবিধ সংস্কার করেন। যেমন- জিজিয়া কর রহিত, বিজিত হিন্দুদের ধন সম্প নিষিদ্ধ, বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন। তিনি সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করার প্রয়াস পান। মুগল সাম্রাজ্যের সংগতি আকবরের সাফল্যজনক রাজপুত নীতির উপর নির্ভরশীল ছিল।
৬. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা : সম্রাট আকবরের সফলতা ও খ্যাতির অন্যতম সোপান ছিল পরধর্মসহিষ্ণুতা। অর্থাৎ সুলइ-ই-বু উদারনীতি দ্বারা পরিপুষ্ট যুগে হিন্দু মুসলমানদের একটি ছায়াতলে আনয়নের জন্য এটা ছিল সর্বাপেক্ষা উপযোগী নীতি।
আ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সব ধর্মের উপাসানে একটি কৃষ্টির উদ্ভব করেন। এটাই দ্বীন-ই-ইলাহি নামে পরিচিত।
৭. শাসনব্যবস্থা : সম্রাট আকবর বিদেশি হলেও বিজিত ভারতবাসীর সাথে তিনি নিজের একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে তার ব্যবস্থাবলি অনেকাংশে স্থায়ী ছিল।
শাসক এবং প্রজাদের মধ্যে বিশ্বস্ততা ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য এবং প্রজাদের বিশ্বাস, আস্থা ও শ্রদ্ধা লাভের জন্য তিনি সময়োপযোগী প্রজাহিতৈষী নীতি গ্রহণ করেন।
৮. রাজস্ব নীতি : মহামতি আকবর শেরশাহের রাজস্বব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে যে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জন করেন তা তার অসামান্য মেধার পরিচায়ক।
তিনি ভূমি রাজস্ব নীতি ও প্রশাসনে এক অভিনব অধ্যায়ের সূচনা করেন। স্মিথ বলেন, “আকবরের রাজস্বব্যবস্থা ছিল প্রশংসনীয়, নীতিমালা ছিল খুবই যথোপযুক্ত।
৯. মনসবদারি ব্যবস্থা : আকবরের সামরিক সংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন। ১৫৭১ সালে আকবর শাহবাজ খানকে মীর বকশি নিযুক্ত করে তার সাহায্যে মনসবদারি প্রথার ভিত্তিতে একটি অভিনব বাহিনী গড়ে তোলেন।
১০. শ্রেষ্ঠ সংগঠক আকবর : মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সংগঠক। কারণ বাবর প্রতিষ্ঠিত তুর্কি সাম্রাজ্য হুমায়ূনের রাজত্বকালে বিপর্যস্ত হলেও আকবরের কূটনৈতিক দক্ষতায় ও সমরকুশলতায় কেবল আফগান ষড়যন্ত্রই ধূলিস্যাৎ হয়নি বিজিত অঞ্চলগুলো সুসংঘবদ্ধ হয়।
এডওয়ার্ড প্যারেট বলেন, “তার রাজত্বকালে মুঘলগণ সামান্য আক্রমণকারী থেকে স্থায়ী ভারতীয় রাজবংশে রূপান্তরিত হয়। "
১১. বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ : কানুনগো বলেন, “জাতীয় বিধান কথার মহান ধারণার জন্য তিনি ভারতীয় শাকসদের মধ্যে শীর্ষ স্থান অধিকার করেন।"
হেগের মতে, "তিনি একমাত্র না হলেও সর্বপ্রথম ভারতীয় সম্রাট যিনি একটি সর্বজয় জাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা একটি সংঘবদ্ধ দেশবাসীকে শাসনের প্রয়াস পান এবং # রাজপুত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রতিপালিত জাতির প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করা হয়।”
১২. নবরত্ন সভা : সম্রাট আকবরের সাফল্যের প্রধান উৎস শক্তি ছিল তার বিচক্ষণ নবরত্ন সভা। এ সভার সদস্যগণ তার রাজদরবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল অসামান্য। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবুল ফজল, ফৈজী, টোডরমল, বীরবল, মানসিংহ, তানসেন, মোল্লা-দো-পিয়াজা প্রমুখ ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “সমস্ত কিছু বিচার করে বলা যায় সে, তিনি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাটের সমকক্ষ এবং শ্রেষ্ঠত্ব দাবির মূলে ছিল তার মহান ও মৌলিক বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক কাঠিন্য এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মোক্ষম ফলাফল।”
অসামান্য মেধা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সীমাহীন অনুসন্ধিৎসা আকবরের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রমাণিত করে, যা তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার বিশেষ জ্ঞান রয়েছে।