সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি কি ছিল
সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি কি ছিল |
সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি কি ছিল
- অথবা, সম্রাট আকবরের “রাজপুত নীতি” ব্যাখ্যা কর।
- অথবা, রাজপুতদের প্রতি আকবরের নীতির আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সম্রাট আকবর তার ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সালের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের লক্ষ্যে যেসব নীতি ও পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করেছিলেন তার মধ্যে রাজপুত নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারতবর্ষে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল শ্রেণির আন্তরিকতা থাকা দরকার । তাই আকবর রাজপুত জাতির সন্তুষ্টি লাভের জন্য কতিপয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন।
তাই বলা যায়, হিন্দু রাজপুত জাতির সন্তুষ্টি ও আনুগত্য লাভের জন্য তাদেরকে যেসব সুযোগ-সুবিধা দান করেন ইতিহাসে তা আকবরের রাজপুত নীতি নামে পরিচিত ।
→ রাজপুত নীতির অর্থ : ভারতে মুঘল আধিপত্য সর্বাত্মক করতে আকবর রাজপুতদের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ড়াই তিনি তাদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করেন এবং তাদের সাথে মিলনাত্মক নীতি অবলম্বন করে তাদেরকে কতিপয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। এটাই ইতিহাসে আকবরের রাজপুত নীতি নামে পরিচিত।
→ রাজপুত নীতির প্রয়োজনীয়তা : মুঘল আধিপত্য বিস্তারে রাজপুতদের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। নিম্নে আকবরের রাজপুত নীতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো :
১. সকল সম্প্রদায়ের শুভেচ্ছা অর্জন : ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই রাজপুত রাজারা মুসলমানদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
উদারমনা ও পরমতসহিষ্ণু সম্রাট আকবর বুঝতে পারেন যে, পূর্বসূরিদের মতো বিদ্রোহাত্মক -মনোভাব পোষণ করলে আজীবন রাজপুতদের বিরোধিতার মোকাবিলা করে সামরিক শক্তি ক্ষয় করতে হবে।
তাই তিনি শত্রুতার পথ পরিহার করে রাজপুতদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের শুভেচ্ছা লাভ করতে সচেষ্ট হন।
২. সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি : সম্রাট আকবরের সিংহাসন লাভের পর থেকে শাহ মনসুর, মির্জা মুহম্মদ হাকিম, অভিভাবক বৈরাম খান এবং সর্বশেষ পুত্র সেলিম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
একজন দূরদর্শী শাসক হিসেবে আকবর বুঝতে পারেন যে, ঘরের শত্রুদের মতো যদি বহিঃশত্রু রাজপুতর ও ভার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয় তবে মুঘল সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য আকবর রাজপুতদের সহানুভূতি ও স্থিতিশীলতা লাভে সচেষ্ট হন।
৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য : রাজপুতরা ছিল দুর্ধর্ষ ও রণনিপুণ যোদ্ধা। সম্রাট আকবর রাজ্যবিস্তারে রাজপুতদের এ শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের সাথে মিলনাত্মক নীতি গ্রহণ করেন।
৪. বংশের দুর্বলতা : সম্রাট আকবর জানতে পারেন যে, ভারতে যেসব রাজবংশ শাসন করে আসছে তাদের মধ্যে তার বংশই ছিল সবচেয়ে দুর্বল। তাই তিনি রাজপুতদের হৃদয় জয় করতে সচেষ্ট হন।
৫. মাতা ও গৃহশিক্ষকের প্রভাব : আকবরের মাতা ও বাল্য শিক্ষক আব্দুল লতিফ তার মনে উদারনীতি জাগরিত করেন। যার প্রস্তাবে তিনি রাজপুত নীতি গ্রহণ করেন ।
→ সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতিসমূহ : নিয়ে সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতিসমূহ বর্ণনা করা হলো ।
১. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন : রাজপুতদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সম্রাট আকবর তাদের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৫৬২ সালে আকবর জয়পুরের রাজা বিহারীমলের কন্যা যোধাবাঈকে বিবাহ করেন।
১৫৭০ সালে আকবর বিকানির ও জয়সলমিরের রাজকন্যাদের বিয়ে করেন। ১৫৮৪ সালে আকবর নিজের ন্যায় পুত্র সেলিমকে অমরের রাজা ভাগবানদাসের কন্যা মনাবাঈ এর সাথে বিবাহ দেন।
২. উচ্চপদে রাজপুতদের নিয়োগ : শুধু বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেই আকবর ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো অধিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য রাজপুতদের সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন উচ্চপদ দান করেন।
রাজা বিহারীমল, টোডরমল, রাজা বীরবল, ভগবান দাস, মানসিংহ প্রমুখ রাজপুত আকবরের দরবারে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করেন।
৩. ধর্মীয় স্বাধীনতা : সম্রাট আকবর হিন্দু সকল সম্প্রদায়কে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেন।
৪. উদার মনোভাব : মেবারের রানা প্রতাপ সিংহ মুঘলদের | বশ্যতা স্বীকারে অস্বীকৃতি জানালে সম্রাট আকবর অন্যান্য রাজপুত রাজার সহায়তায় তাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। কিন্তু সম্রাট আকবর বিজিত রাজপুতদের উপর কোনো অত্যাচার করতেন না।
৫. তীর্থকর রহিতকরণ : ১৫৬৩ সালে সম্রাট আকবর হিন্দু রাজপুতদের তীর্থকরা বন্ধ করেন।
৬. জিজিয়া কর মওকুফ : ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক রাজপুতগণ সম্রাটকে জিজিয়া কর প্রদানে বাধ্য ছিল। কিন্তু সম্রাট আকবর ১৫৬৪ সালে রাজপুতদের কাছ থেকে জিজিয়া কর প্রত্যাহার করে নেন।
৭. হিন্দুধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান : সম্রাট আকবর হিন্দু ও রাজপুত জাতির বহু আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মাঝে মাঝে হিন্দুদের হোলি, রাখী, দীপালি প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন।
৮. পশু জবাই নিষিদ্ধকরণ : হিন্দু জাতির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না দেওয়ার জন্য সম্রাট আকবর সপ্তাহের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে পশু জবাই নিষিদ্ধ করেন। সম্রাট আকবর গরু জবাই নিষিদ্ধ করে রাজপুতদের খুশি রাখার চেষ্টা করেন।
৯. মন্দির নির্মাণ : সম্রাট আকবর রাজপুত সম্রাজ্ঞীদের উপাসনার জন্য রাজপ্রাসাদে মন্দির নির্মাণ করেন। যা রাজপুতদের সন্তুষ্টি লাভে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
১০. বাল্যবিবাহ সংশোধন : সম্রাট আকবর হিন্দু সমাজব্যবস্থার অনেক সংস্কার সাধন করেন। তিনি হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত বাল্যবিবাহ প্রথা সংশোধনের চেষ্টা করেন।
১১. বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ : তৎকালে হিন্দু সমাজে বর্ণ বৈষম্য প্রথা ছিল প্রবল। এ প্রথা মানুষে মানুষে যে প্রভেদ তৈরি করে সম্রাট তা দূরীকরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
১২. হিন্দু সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা : সম্রাট আকবর ছিলেন হিন্দু সংস্কৃতির একজন উদার পৃষ্ঠপোষক। তিনি হিন্দু কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ ও চিত্রশিল্পীদের স্ব-স্ব কাজে উৎসাহ প্রদান করতেন।
→ রাজপুত নীতির ফলাফল : রাজপুতদের অনুসৃত নীতির ফলে সম্রাট আকবরের প্রতি তাদের আস্থার মনোভাব সৃষ্টি হয়। তিনি রাজপুতদের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে রাজপুত বিরোধিতার অবসান ঘটাতে সক্ষম হন।
সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থায় তাদের সহযোগিতায় বিশেষ অবদান রাখে। মেবারের রানা সংগ্রাম ছাড়া সকল রাজপুত রাজা আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।
বিজেতা, শাসক ও সংস্কারক হিসেবে আকবরের যে শ্রেষ্ঠত্ব তাতে রাজপুতদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই ঐতিহাসিক ভি.ডি. মহাজন বলেন, “Thus by a policy of conciliation Akbar was able to win over the affection of the Rajputs and there by solidify the foundation of the Mughol Empire in the country."
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি বিশেষভাবে go বছরের রাজত্বকালে উল্লেখযোগ্য। তিনি রাজপুতদের মাঝে এক অটল বিশ্বাস গড়ে তোলেন। তাছাড়া তিনি মন্দির নির্মাণ করেন।
তীর্থ ও জিজিয়া। কর তুলে দেন। আকবর তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য রাজপুত নীতি গ্রহণ করেন। এ নীতিতে তিনি সফলতা লাভ করেন।