হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয় আলোচনা কর
হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয় আলোচনা কর |
হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয় আলোচনা কর
- অথবা, সম্রাট হুমায়ূনে ভাগ্য বিপর্যয়ের বিবরণ দাও।
- অথবা, "Humayun tumbled through life and tumbled out of it"-উক্তিটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : ভারতবর্ষে মুঘল শাসকদের ইতিহাসে দুর্ভাগ্যবান শাসক হিসেবে যিনি পরিচিত তিনি হচ্ছেন সম্রাট হুমায়ূন। তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি বাবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। হুমায়ূন বাবরের পুত্র হলেও বাবরের মতো দূরদর্শিতা তার মধ্যে ছিল না।
বিশেষ করে হুমায়ূন সিংহাসনে আরোহণের পরেই তার ভাইদের ও বিভিন্ন দিকের ষড়যন্ত্রে হুমায়ূন কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের সঠিক পন্থাও হুমায়ূন জানত না। এজন্য হুমায়ূনকে রাজ্য ছাড়তে হয় এবং দীর্ঘদিন ছন্নছাড়া জীবনযাপন করতে হয়।
- হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয় : সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর ১৫৩০ সালে হুমায়ূন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। হুমায়ূন শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাগ্যবান।
কিন্তু ভারতবর্ষের শাসকদের ইতিহাসে তার ন্যায় হতভাগ্য শাসক আর দেখা যায় না। আর এজন্য ঐতিহাসিক লেনগুল মন্তব্য করেন যে, 'umayun tumbled through life and tumbled out - of in "
নিম্নে হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয় আলোচনা করা হলো :
১. অসংগঠিত সাম্রাজ্য লাভ : হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রথম কারণ ধরা হয় তার অসংগঠিত সাম্রাজ্য লাভকে। ভারতবর্ষে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর তার পুত্র হুমায়ূনের জন্য কোনো সুগঠিত সাম্রাজ্য রেখে যাননি।
তাছাড়া বাবর ভারতবর্ষের অনেক জায়গা জয় করলেও সেগুলোর শক্তিশালী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারেননি। যার ফলে হুমায়ূন সিংহাসনে আরোহণ করার পরই শত্রুপক্ষ পুনরায় জাগ্রত হয়ে উঠে।
২. ভাইদের ভূমিকা : হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ে তার ভাইনের ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। হুমায়ূনের সিংহাসন লাভকে তার ভাইয়েরা ভালোভাবে নেননি।
তাই তার ভাইয়েরা ছিল তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। শান্তিপ্রিয় হুমায়ূন তার পিতার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার ভাইদেরকে বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন।
কিন্তু তার ভাইয়েরা চাইত হুমায়ূনকে সরিয়ে নিজেদের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে নিতে। যা হুমায়ুনের জন্য বিপদ ডেকে আনে।
৩. অর্থাভাব : অর্থভাব ছিল হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের আরকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। হুমায়ূনের পিতা বাবর ছিলেন একজন দানশীল শাসক।
তিনি বিভিন্ন এলাকা জয় করে যেসব অর্থ লাভ করেন তার পুরোটাই তিনি মুক্তহস্তে দান করে দেন। যার ফলে হুমায়ূন যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন রাজকোষ ছিল প্রায় শূন্য।
অথচ শত্রুদের দমন করতে এবং সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই এ অর্থাভাব হুমায়ূনকে ভাবিয়ে তোলে এবং তার বিপর্যয় ডেকে আনে
৪. সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা : সামরিক বাহিনীর দুর্বলত ছিল হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ। হুমায়ূন পৈতৃক সূত্রে সে সামরিক বাহিনী পায় তা সুগঠিত ছিল না।
কেননা আফগান বাহিনী ছিল নানা জাতি ধর্ম ও ভাষাভাষীদের নিয়ে গঠিত। বাবর তার নিজ বুদ্ধি দিয়ে তার সৈন্যবাহিনীকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন সেই নিয়ন্ত্রণ গুণ হুমায়ূনের ছিল না। যার ফলে হুমায়ূনের সুবিন্যস্ত মুঘল বাহিনী জাতীয় স্বার্থের চেয়ে শিশু স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিত।
৫. হুমায়ূনের চরিত্রিক দুর্বলতা : হুমায়ূনের চারিত্রিক দুর্বলতাই ছিল অনেকাংশে হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য । যদিও হুমায়ূনের সামনে যথেষ্ট বাধা-বিপত্তি ছিল এতে সন্দেহ নেই।
তবু যদি হুমায়ূনের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকত তাহলে হুমায়ূন সহজেই সেগুলো মোকাবিলা করতে পারতেন।
কিন্তু হুমায়ূনের মধ্যে বিচক্ষণতা, অধ্যবসায় ও দৃঢ় সংকল্পের অভাব ইত্যাদি চারিত্রিক দুর্বলতা ছিল। এমনকি তার ভাই কামরান যখন তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে লাহোর অধিকার করেন তখনও হুমায়ূন নিরবে সব সহ্য করেন।
৬. হুমায়ূনের নীতিগত ত্রুটি : হুমায়ূনের মধ্যে নীতিগত কিছু ত্রুটি ছিল। বাবরের মৃত্যুর ৬ মাস পর ১৫৩১ সালে হুমায়ূন বুন্দেলখণ্ডে সুরক্ষিত কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ হুমায়ুনের কোনো কাজেই আসেনি।
এমন সময় তিনি পূর্ব সীমান্তে মাহমুদ লোদীর শক্তি বৃদ্ধির খবর পান এবং কালিঞ্জর বিজয় সম্পন্ন না করেই কালিঞ্জরের রাজার সাথে অর্থের বিনিময়ে সন্ধি করে পূর্বদিকে মাহমুদ লোদীকে দমন করার জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু হুমায়ূনের কালিঙ্করের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি জয় করা প্রয়োজন ছিল।
৭. বিলাসিতা ও অসম্পূর্ণ বিজয় : হুমায়ূনের বিলাসিতা ও অসম্পূর্ণতা তার ভাগ্য বিপর্যয় ডেকে আনে। হুমায়ূন তার সময়ে যতগুলো অভিযান পরিচালনা করেছেন তার কোনোটিতেই তিনি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেননি। তিনি নামমাত্র বিজয় লাভ করে।
"শত্রুপক্ষের মূল উৎপাটন না করেই ফিরে আসেন। যার ফলে শত্রুরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাছাড়া হুমায়ূনের বিলাসিতা তথা আরামপ্রিয়তা তার ভাগ্যে বিপদ ডেকে আনে।
৮. শেরশাহের পারদর্শিতা : হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে শেরশাহের পারদর্শিতা। শেরশাহ ছিলেন অত্যন্ত কূটকৌশলী ও যুদ্ধে পারদর্শী।
তার সামনে হুমায়ূন ছিল রীতিমত ধরাশায়ী। শেরশাহ হুমায়ূনকে তার পিছেপিছে ঘুরান এবং তাকে পরাজিত করেন।
হুমায়ূন ইচ্ছা করলে চুলার দুর্গ অবরোধের সময়েই শেরশাহকে কতল করতে পারত। কিন্তু শেরশাহের পলায়নে হুমায়ূনের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।
৯. যাযাবর জীবনযাপন : হুমায়ূনের ভাগ্য বিপর্যয়ের চরম মুহূর্ত অনুভব করা যায় তার যাযাবর জীবনযাপন প্রত্যক্ষের মাধ্যমে । শেরশাহের সাথে দুইবার যুদ্ধে হেরে হুমায়ূন দিল্লি ত্যাগ করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
কিন্তু হতভাগ্য হুমায়ূনকে তার আপন ভাইয়েরাসহ সকলেই আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে হুমায়ূন প্রায় ১০ বছর ছন্নছাড়া ও মানবেতর জীবনযাপন করেন।
১০. দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু : হুমায়ূন পারস্যের সম্রাটের সহযোগিতায় দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে পারলেও দুর্ভাগ্য হুমায়ূনের পিছ ছাড়েনি।
১৫৫৬ সালে তিনি লাইব্রেরির সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান। এতে তিনি গুরুতর ভাবে আহত হন এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দুর্ভাগ্য কখনোই হুমায়ূনের পিছু ছাড়েনি। হুমায়ূন সিংহাসনে আরোহণের পরই তার ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরু হয় এবং দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।
অর্থাৎ সারাজীবনের হোঁচট খাওয়া হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত হোঁচট খেয়েই মারা গেলেন। এজন্যই লেনপুল বলেছেন, “Humayun tumbled through life and tumbled out of it."