হুমায়ুন ও শেরশাহের সংঘর্ষের বিবরণ দাও
হুমায়ুন ও শেরশাহের সংঘর্ষের বিবরণ দাও |
হুমায়ুন ও শেরশাহের সংঘর্ষের বিবরণ দাও
- অথবা, মুখল আফগান ই হুমায়ূন ও শেরশাহের মধ্যকার সংঘর্ষের মূল কারণ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : অতীত কাল থেকে পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটা বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, আর তা হলো দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ। আর এই দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারণ হলো ক্ষমতা ও অধিপত্যের দখল।
আমরা দেখি যুগে যুগে পৃথিবীতে যেসব দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়েছে তার জন্য প্রাণ দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের মূলে ছিল হয় নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা অথবা নিজের প্রভুত্ব জাহির করা।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা ঐ একই দৃশ্য দেখতে পাই। ১৫৩০ সালে সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ূন সিংহাসনে বসেন।
সিংহাসনে বসার প্রায় পর পরই পিতার দখল করা সাম্রাজ্য পূর্ব শত্রু আফগানদের রোধানলে পড়ে। ফলে হুমায়ূন-শেরশাহ দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ শুরু হয়।
মুঘল আফগান দ্বন্দ্ব : নিয়ে মুঘল আফগান দ্বন্দ্বই হুমায়ূন ও শেরশাহের মধ্যকার সংঘর্ষের মূল কারণ, তা ব্যাখ্যা করা হলো।
১. হুমায়ূনের চুদার দুর্গ অবরোধ : আফগানদের পরাজিত করে বাবর মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে স্বাভাবিকভাবেই আফগানরা মুঘলদের শত্রুতে পরিণত হয়। তাই বাবরের মৃত্যুর পর তারা আবার সংগঠিত হতে শুরু করে।
ফলে হুমায়ূন শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী আফগান দলপতি মাহমুদ লোদীকে পরাজিত করে শেরশাহের নিকট হুমায়ূন চুনার দুর্গ দাবি করলে শেরশাহ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে হুমায়ূন ৬ মাস [ ধরে চুনার দুর্গ অবরোধ করে রাখেন।
২. শেরশাহের বাংলা অভিযান : হুমায়ূন চুনার দুর্গ অবরোধ তুলে নিয়ে গুজরাট অভিযান শুরু করেন। আর এই সুযোগে শেরশাহ বাংলা অভিযান পরিচালনা করেন এবং একরকম বিনা বাধায় গৌড় দখল করেন। এ সময় শেরশাহ হুসেনশাহী সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের নিকট থেকে প্রচুর স্বর্ণ ও কয়েকটি অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায়।
৩. শেরশাহের রোটার্স দুর্গ ও বাংলাদেশ বিজয় : হুমায়ূন গুজরাট অভিযান শেষ করে দিল্লিতে ফিরলে শেরশাহের অভিযানের খবর পান। ফলে তিনি বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা হন।
কিন্তু সরাসরি বাংলা অভিযান না করে চুনার দুর্গ দখল করেন। এই সুযোগে শেরশাহ বিহারের সুরক্ষিত রোটার্স দুর্গ দখল করেন এবং ১৫৩৮ সালে তিনি বাংলাদেশ ও বিহার দখল করেন।
৪. বানারস, চুনার দুর্গ, জৌনপুর ও কনৌজ বিজয় : চুনার দুর্গ দখল করে হুমায়ূন বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা হন এবং এক রকম বিনা বাধায় গৌড় দখল করে নাম দেন জান্নাতাবাদ।
এদিকে শেরশাহ হুমায়ূনকে বাংলায় ব্যস্ত রেখে পুনরায় চুনার দুর্গ দখল করেন। এছাড়াও তিনি বানারস, জৌনপুর ও কনৌজসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. চৌসার যুদ্ধ : চৌদার যুদ্ধ শেরশাহ ও হুমায়ুনের মধ্যে প্রথম মুখোমুখি যুদ্ধ । জৌনপুর ও কনৌজ শেরশাহ দখল করলে ১৫৩৯ সালে হুমায়ূন স্বসৈন্যে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন।
কিন্তু পথিমধ্যে বক্সারের নিকটবর্তী গঙ্গা নদীর তীরে চৌদা নামক স্থানে শেরশাহ হুমায়ূনের গতিরোধ করেন। চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হয় এবং কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন।
→ সংঘর্ষের কারণ : নিয়ে সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. ক্ষমতার প্রতি লোভ : হুমায়ূন ও শেরশাহ উভয়েই ছিল ক্ষমতা বিলাসী। উভয়েই চেয়েছেন সমগ্র ভারতে নিজ নিজ আধিপত্য। ফলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
হুমায়ূন বিভিন্ন সময়ে শেরশাহের পিছু নিয়েছে তাকে শায়েস্তা করার জন্য। আবার শেরশাহও নিজের মেধা, যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।
২. হুমায়ূনের ঈর্ষা : বাবরের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়েই মূলত মুঘল-আফগান দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। আফগানরা তাদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে।
এদিকে শেরশাহ বিভিন্ন দুর্গ ও বাংলাদেশ জয় করলে হুমায়ূন শেরশাহকে শাস্তি দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন । তাঁর এই ঈর্ষার কারণে দ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত হয় ।
৩. আফগানদের তীব্র জাতীয়তাবাদ : আফগানরা জাতি হিসাবে ছিল খুবই জাতীয়তাবাদী। বাবরের নিকট পরাজিত হয়ে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
তারা খুবই অপমানিত বোধ করে এবং ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা শুরু করে। তারা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তাদের আন্দোলন পরিচালনা করে।
৪. সংযমহীনতা : শেরশাহ ও হুমায়ূন কারোরই যথেষ্ট সংযম ছিল না। তারা সবসময় পরস্পরকে পরাজিত করার বিভিন্ন কাজে মগ্ন থাকতো।
তাদের মধ্যে ছোট ছোট অঞ্চল দখল-বেদখল ইত্যাদি লেগেই থাকতো। ফলে হুমায়ূন রেগে গিয়ে শেরশাহের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে । আবার শেরশাহও পাল্টা প্রতিরোধ করে ।
→ ফলাফল : নিয়ে সংঘর্ষের ফলাফলসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. শেরশাহের ক্ষমতা বৃদ্ধি : চৌসার যুদ্ধে জয়ের পর শেরশাহের মনোবল বৃদ্ধি পায়। সে ছোট অঞ্চলের পরিবর্তে সমগ্র ভারত দখলের পরিকল্পনা করে।
আর বিভিন্ন দুর্গ ও অঞ্চল দখল তার মনোবল বৃদ্ধি করে। এভাবে ধীরে ধীরে শেরশাহ শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং সাম্রাজ্য দখলে তৎপর হয়ে উঠে
২. সিংহাসন লাভ : ধীরে ধীরে শেরশাহ ও হুমায়ূনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। শেরশাহ ও হুমায়ূনের মধ্যে পরপর কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এর মধ্যে চৌসার যুদ্ধে পরাজয় হুমায়ূনকে চরমভাবে দুর্বল করে দেয়। এরপর নিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হয়। এভাবে শেরশাহ দিল্লির সিংহাসন দখল করেন এবং ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন ।
৩. হুমায়ূনের ভাগ্য বিড়ম্বনা : বাবর মারা গেলে হুমায়ূন খুব অল্প বয়সে সিংহাসনে বসেন। তাই স্বভাবতই বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ শেরশাহের সাথে তিনি পেরে উঠছিলেন না।
অবশেষে বাবার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য হারান । ফলে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। এভাবে তিনি ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হন ।
৪. শেরশাহের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : শেরশাহ খুবই বিচক্ষণ ও জনদরদী শাসক ছিলেন। তিনি দিল্লির ক্ষমতা লাভের পর বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। রাস্তাঘাট নির্মাণ, জলাধার নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ করেন।
ফলে সাম্রাজ্যে সৈন্য সাধারণ জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আর এর ফলে হুমায়ূন এখানে তার প্রভাব হারাতে থাকে। এছাড়াও হুমায়ূন যুদ্ধে তার রাজত্ব হারায়। ফলে তার আর্থিক অভাব দেখা দেয়, ফলে তার শক্তিও কমতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাবরের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে আফগান শাসনের অবসান ঘটে। তাই স্বভাবতই আফগানরা তাদের ক্ষমতা পুনর্দখলের চেষ্টা চালায়।
বিশেষ করে শেরশাহ বিভিন্ন সময় মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায় এবং দখল করে। আবার হুমায়ূন পরে তা পুনর্দখল করে।
শেরশাহের বাংলাদেশ অভিযান পরে হুমায়ূনের শেরশাহের দিকে যাত্রা মূলত মুঘল আফগান দ্বন্দ্বেরই প্রতিফলন। আফগানরা চরম জাতীয়তাবাদী হওয়ায় তারা সাম্রাজ্য দখলে তৎপর হয়। ফলে শেরশাহ দিল্লির ক্ষমতা দখলে সক্ষম হন।