বাঙালি সমাজে হিন্দু অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে আলোচনা কর
বাঙালি সমাজে হিন্দু অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে আলোচনা কর |
বাঙালি সমাজে হিন্দু অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, বাঙালি সমাজে হিন্দু অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ।
উত্তর : ভূমিকা : সুবাদারি আমলে বাংলার অভিজাত শ্রেণিতে হিন্দুদের সংখ্যা নগন্য থাকলেও পলাশি যুদ্ধের প্রাক্কালে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির সংখ্যাধিক্য ও প্রভাব ছিল প্রচুর।
বিশেষ করে নবাবি আমলে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির আবির্ভাব এবং বাংলার প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের দীপ্ত পদচারণা একটি বিশেষ লক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে ওঠে।
— বাঙালি সমাজে হিন্দু অভিজাত শ্রেণি : অভিজাত শ্রেণি আবার বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা-
১. হিন্দু কর্মচারী অভিজাত শ্রেণি : সুবাদারি আমলে সুবাদার, দেওয়ান, বখশী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দীর্ঘ তালিকার মধ্যে একমাত্র মানসিংহ ছিলেন সুবাদার এবং জওহরলাল দাস মাত্র কয়েক মাসের দেওয়ান।
তাছাড়া এ সময় সামান্য কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু মনসবদার ছিলেন যাদেরকে অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হতো।
কিন্তু নবাবি আমলে বাংলার নবাবরা তাদের স্বাধীন শাসন বজায় রাখার জন্য সব শ্রেণির লোকের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করতে চেয়েছিলেন।
ফলে নবাবরা হিন্দুদেরকে রাজকার্যে এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতেন। রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে হিন্দু রাজকর্মচারীরা একটি বিরাট রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়।
নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে (১৭২৭-৩৭) হিন্দু কর্মচারী অভিজাত শ্রেণির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
নবাব আলীবর্দী খানের সময় ব্যাংকার জগৎশেঠ আলীবর্দী খানের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি ছিলেন। নবাবের | উপদেষ্টা পরিষদে তার খুব প্রভাব ছিল।
মেদেনীপুরের রাজা রামরাম সিংহ গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। তাছাড়া রাজা দুর্লভ রায়, রামনারায়ণ রাজবল্লভ, উমিচাঁদ ও অন্যান্য হিন্দু নবাবের সাময়িক ও বেসামরিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে বহাল থাকতেন।
সরকারি কাজে হিন্দুদের খুব প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেক বিভাগে তারা এমনভাবে বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয় যে, কোন সময়ে সামান্য একটি কাজও তাদের সহযোগিতা ব্যতীত এবং তাদের অগোচর হতে পারতো না । এই অভিজাত শ্রেণির প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল সীমাহীন।
২. হিন্দু জমিদার অভিজাত শ্রেণি : নবাবি আমলে হিন্দুদের কিছুসংখ্যক বিভিন্ন অঞ্চলের রাজস্ব বিভাগে ও দেওয়ান পদে নিযুক্ত হওয়ায় তারা কালক্রমে ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে ভূ-স্বামী বা জমিদার হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই জমিদার শ্রেণি প্রজাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে তাদের উপর কর্তৃত্ব করত। আলম চাঁদ, যশোবন্ত রায়, নন্দলাল, জগৎশেঠ, উমিদ রায়, প্রমুখ দেওয়ানও রাজস্ব বিভাগে চাকরির সূত্র ধরে, বিশাল সম্পত্তির মালিকানার ফলে জমিদার শ্রেণিরূপে নিজেদের আভিজাত্য বজায় রাখতেন।
৩. ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণি : পলাশি যুদ্ধের প্রাক্কালে বাঙালি সমাজে ব্যবসায়ী শ্রেণি একটি সমৃদ্ধশালী অভিজাত শ্রেণি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
নবাবি আমলে মুসলমান ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণির তুলনায় হিন্দু ব্যবসায়ী ও বণিক শ্রেণি একটি সমৃদ্ধ সামাজিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদের মধ্যে মুর্শিদাবাদের শেঠ পরিবার ও উমিচাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি করে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেন।
জমিদাররা জগৎশেঠের ব্যাংকের মাধ্যমে নবাবের কোষাগারে রাজস্ব জমা দিত এবং নবাবরাও আর্থিক প্রয়োজনে এই ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণির নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করত।
বণিক শ্রেণির মধ্যে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদের দরবারে অসামান্য সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। তার এত প্রতিপত্তি ছিল যে, নবাব সুজাউদ্দিন থেকে সিরাজ-উদ-দৌলার খাস মন্ত্রণালয়ে সর্বদা তার আসন ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নবাবি আমলে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য ছিল অসীম। এসকল অভিজাত শ্রেণির অপরিমেয় ক্ষমতা লাভই সিরাজের পরাজয়ের মূল কারণ।