সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের তুলনামূলক আলোচনা কর
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের তুলনামূলক আলোচনা কর |
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের তুলনামূলক আলোচনা কর
- অথবা, সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের মধ্যে তুলনামূলক যুক্তি উপস্থাপন কর ।
উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরী উভয়ই ভারত আক্রমণকারী হিসেবে পরিচিত। উভয়ই ছিলেন গজনি হতে আগমনকারী মুসলিম বীরযোদ্ধা।
সুলতান মাহমুদ ছিলেন গজনির সুলতান আর মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন নিজ ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিনের অধীনে গজনির শাসনকর্তা।
যদিও মুহাম্মদ ঘুরী ও সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন, কিন্তু দুই জনেরই সমান সামরিক সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য ছাড়াও এই দুই ব্যক্তির আক্রমণের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান ছিল।
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের তুলনামূলক আলোচনা : নিয়ে সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো :
১. ধর্মান্ধনীতি : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান তার ধর্মান্ধনীতি প্রসূত ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কিন্তু মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হলেও ধর্মান্ধনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি এবং তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকেও আচ্ছাদিত করতে পারেনি।
২. সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে : ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত অভিযান করেনি। শুধুমাত্র পাঞ্জাব অধিকার করে সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করে শান্ত ছিলেন।
পাঞ্জাব ব্যতীত নববিজিত অন্যান্য অঞ্চলে তিনি সাম্রাজ্য | স্থাপন করেননি। এ সমস্ত অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে ফিরে গিয়েছেন।
এ জন্য অনেক ঐতিহাসিক তাকে ধর্মান্ধ এবং সম্পদ অপহরণকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে, ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী।
তিনি দেশ জয় করে স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মদ ঘুরী | তৎকালীন ভারতের দুর্বল রাজনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ করেন। আর | সেই কারণেই তিনি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন।
তার ভারত অভিযানের পিছনে অর্থনৈতিক কোনো লোভ-লালসা ছিল না বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন তিনি ভারত অভিযান করে অধিকৃত অঞ্চলে সুসংগঠিত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেন।
৩. ঘুরীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক : মুহাম্মদ ঘুরী তার পূর্ববর্তী ভারত অভিযানকারী সুলতান মাহমুদের চেয়ে বেশি দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। মাহমুদের মতো তিনি শুধু আক্রমণকারী ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন বাস্তবাদী রাষ্ট্রনায়ক।
তিনি তদানীন্তন ভারতের অত্যন্ত শোচনীয় ও দুর্বল রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগও তিনি গ্রহণ করেন।
৪. বিজেতা হিসেবে : সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরী উভয়ই ছিলেন একজন বিজেতা। কিন্তু বিজেতা হিসেবে মাহমুদের কৃতিত্ব মুহাম্মদ ঘুরীর তুলনায় অনেক বেশি। মাহমুদের ১৭ বার ভারত আক্রমণে কোনো পরাজয়ের কথা জানা যায়নি।
অন্যদিকে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতের বিরুদ্ধে অভিযানে ৩ বার পরাজয়বরণ করেন। যে রাজপুত শক্তিকে সুলতান মাহমুদ পরাজিত করেছিলেন সেই রাজপুতদের হাতেই মুহাম্মদ ঘুরী প্রথম অভিযানে পরাজয় বরণ করেন। মুহাম্মদ ঘুরীর এই তিনটি পরাজয় সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতে হয় যে তিনি সার্বিক যুদ্ধে বিজয়ী হন।
৫. জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে : সুলতান মাহমুদ সারা জীবন যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও শিল্প সাহিত্যের চর্চায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা তিনি -সুনাম অর্জন করেন।
কিন্তু মুহাম্মদ ঘুরীর মধ্যে অনুরূপ গুণের অভাব ছিল। আলবেরুনী, ফেরদৌসী, উৎসী প্রমুখ জ্ঞানী ব্যক্তি সুলতান মাহমুদের রাজদরবার অলংকৃত করেছিল।
তার শাসনামলে গজনিতে একটি লাইব্রেরি, একটি জাদুঘর ও অনেক অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছিল। অপরপক্ষে, মুহাম্মদ ঘুরী যোদ্ধা ও সৈনিক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
৬. উদ্দেশ্য : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ভারত থেকে প্রচুর ধনসম্পদ আহরণ করা। ভারত অভিযানে আহরিত ধনসম্পদ দ্বারা সুলতান মাহমুদ গজনি নগরীকে সুসজ্জিত করেন।
অপরদিকে মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের পিছনে কোনো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তার ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
সুলতান মাহমুদ ভারত অভিযান শেষে সম্পদ লুণ্ঠন করেই স্বদেশ ফিরে যেত। সেই বিজিত রাজ্য নিয়ে কোনো চিন্তা করত না। মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে রাজ্য অধিকার করে কীভাবে সাম্রাজ্যে শৃঙ্খলা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুলতান মাহমুদ যুদ্ধবিগ্রহে দক্ষ এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে অন্তরিক ছিলেন। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে ঘুরীর দান সুলতান মাহমুদের দান অপেক্ষা অনেক বেশি।
সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে গজনি রাজ্যের সমৃদ্ধি সাধন করা। কিন্তু ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপন করাই ছিল ঘুরীর অভিযানের মূল উদ্দেশ্য।
ঘুরী ভারতে হিন্দু রাজাগণকে পরাজিত করে ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তাই ভারতে মুসলিম রাজ্যের স্থপতি হিসেবে ঘুরীর নাম সর্বপ্রথমই উল্লেখযোগ্য।