১২টি সোনার তরী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর
সোনার তরী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর |
১২টি সোনার তরী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন-১. ‘সোনার তরী' কবিতার কৃষক ধান নিয়ে কূলে বসে ছিলেন কেন?
উত্তর: 'সোনার তরী' কবিতায় কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসল সোনার ধান পারাপারের আশায় সেগুলো নিয়ে কূলে বসে ছিলেন।
আলোচ্য কবিতার কৃষক ছোটো খেতে তাঁর উৎপাদিত ফসল কেটে জড়ো করেন। কিন্তু ধান কাটার সময় ভারি বর্ষণের সূচনা হয়। ফলে প্রতিকূল পরিবেশে নিঃসঙ্গ কৃষক ধান নিয়ে বিপদে পড়ে যান।
আর তাই সমস্ত ধান নিয়ে পারাপারের আশায় তিনি নদী কূলে বসে ছিলেন। এর মধ্যদিয়ে মূলত শিল্পস্রষ্টা কবির সোনার ধানরূপী কর্মফলসমেত মহাকালের তরীতে স্থান লাভের বাসনা ব্যক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন-২. কবিতাটিতে 'নাহি ভরসা' বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কবিতাটিতে ‘নাহি ভরসা' বলতে ধান নিয়ে অপেক্ষমাণ কৃষকের আশঙ্কার কথা বোঝানো হয়েছে।
ক্ষুরধারা বর্ষায় ভরা নদীর স্রোত দ্বীপসদৃশ ছোটো ধানখেতটির চারপাশে খেলা করছে, যেন মুহূর্তের মধ্যেই খেতটিকে ভাসিয়ে নেবে। এমনই পরিস্থিতিতে সেখানে রাশি রাশি সোনার ধান কেটে অপেক্ষা করছেন নিঃসঙ্গ কৃষক।
মেঘাচ্ছন্ন দিনে সোনার ধানগুলো নিরাপদে পার করতে পারবেন কি না, সে আশঙ্কায় উদ্বেল হয়ে পড়েছিলেন কৃষক। 'নাহি ভরসা' উক্তিটির মাধ্যমে তাঁর সে আশঙ্কার কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন-৩. ‘ধান কাটা হলো সারা' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: ‘ধান কাটা হলো সারা' বলতে পৃথিবীতে কৃষকরূপী মানবের সমস্ত কর্ম সম্পাদিত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
'সোনার তরী' কবিতায় প্রতিটি অনুষঙ্গই বিশিষ্ট রূপক অর্থে প্রকাশিত। কবিতাটিতে কৃষক ব্যক্তিমানুষের প্রতীক আর উৎপাদিত ধান হলো মানুষের কর্মফল। সংগত কারণেই ধান কাটা সারা হওয়া মানে কাজের সমাপ্তি অর্থাৎ কবিতাটিতে ‘ধান কাটা হলো সারা' বলতে মানুষের সম্পাদিত কাজের পরিসমাপ্তিকেই বোঝানো হয়েছে ।
প্রশ্ন-৪. কবিতায় ‘একখানি ছোটো খেত' বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কবিতায় ‘একখানি ছোটো খেত কবিতাংশটি দ্বারা মানুষের কর্মক্ষেত্র হিসেবে পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে।
আলোচ্য কবিতায় প্রতি অনুষঙ্গই রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে উল্লিখিত ছোটো খেতটি কৃষকের চাষাবাদের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হলেও এর গূঢ়ার্থ হলো পৃথিবী অর্থাৎ মানুষের কর্ম সম্পাদনের জায়গা। বস্তুত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করেই পৃথিবীতে মানুষকে কর্মসম্পাদন করতে হয়।
আলোচ্য কবিতাটিতে কবিগুরু মানুষের কর্মক্ষেত্র হিসেবে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এই সীমাবদ্ধ পৃথিবীকেই 'একখানি ছোটো খেত' বলে উপমিত করেছেন ।
প্রশ্ন-৫: ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’– বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: ধান কেটে অপেক্ষমাণ কৃষকের সামনে এক মাঝির আগমন হলে প্রথম দেখায় মাঝিকে তার পরিচিত বলে মনে হয় ।
আলোচ্য কবিতায় বর্ষার বৈরী পরিবেশে বিপদাপন্ন এক কৃষককে কেন্দ্র করে কবিতাটির ভাবসত্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। সেখানে সোনার ধানরূপী কর্মফল নিয়ে কৃষক অপেক্ষমাণ। চারদিকে বর্ষার ক্ষুরধারা পানি ঘুরে ঘুরে খেলা করছে, যেন মুহূর্তেই ভাসিয়ে নেবে তাঁর ছোটো খেতটিকে।
এমনই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে হঠাৎ সেখানে এক মাঝির আগমন হয়। মহাকালের প্রতীক এই মাঝিকে ব্যক্তি কৃষকের পরিচিত বলে মনে হতে থাকে । প্রশ্নোক্ত চরণটিতে এ বিষয়টিই ফুটে উঠেছে।
প্রশ্ন-৬. মাঝি চলে যাওয়ার সময় কোনোদিকে তাকায়নি কেন?
উত্তর: মহাকালরূপ মাঝি জাগতিক ঘটনা সম্পর্কে নিরাবেগ বলে চলে যাওয়ার সময় সে কোনোদিকে তাকায় না ।
আলোচ্য কবিতায় মাঝি মূলত মহাকালের প্রতীক। আর মহাকাল কেবল মানুষের কর্মফলকেই গুরুত্ব দেয়। সেখানে ব্যক্তিমানুষ বা জাগতিক ঘটনাবলির স্থান নেই। অর্থাৎ জাগতিক ব্যস্ততা মহাকালকে স্পর্শ করতে পারে না।
এ বিষয়ে মহাকাল সর্বদাই নিরাসক্ত ও নিরাবেগ। এ কারণেই মহাকালরূপ মাঝি চলে যাওয়ার সময় কোনো দিকে তাকায়নি । প্রশ্ন-৭. 'সোনার তরী' কবিতায় 'সোনার ধান' প্রতীকে কবি কী বুঝিয়েছেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: 'সোনার তরী' কবিতায় 'সোনার ধান' প্রতীকে কবি সৃষ্টিশীল মানুষের মহৎ কর্মকে বুঝিয়েছেন ।
এ পৃথিবীতে সবকিছুই নশ্বর। অবিনশ্বর শুধু মানুষের মহৎ কীর্তি। মহাকালের চিরন্তন স্রোতে মানুষ তার অনিবার্য মৃত্যুকে এড়াতে পারে না। কেবল বেঁচে থাকে সোনার ফসল অর্থাৎ মানুষের মহান কীর্তি।
কর্মফলরূপী সোনার ধান মহাকালের উদ্দেশে ধাবমান সোনার তরীতে স্থান পেলেও ব্যক্তিমানুষের সেখানে স্থান হয় না। মহাকালের নিষ্ঠুর করালগ্রাস মানুষকে ফেলে যায় বিস্মৃতি আর অবহেলার মধ্যে; শুধু গ্রহণ করে তার মহৎ কীর্তি— যাকে কবি 'সোনার ধান' বলে উপমিত করেছেন ।
প্রশ্ন-৮. সোনার তরীটি দেখে কৃষকের মনে কেমন ভাবোদয় হলো?
উত্তর: নিশ্চিত বিলীন হওয়ার আশঙ্কার মাঝে হঠাৎ করে তরীটিকে দেখার পর কৃষকের মনে নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়ার আশা জাগে । বিপন্ন পরিবেশে একলা কৃষক আশু সংকটকে মেনেই নিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ করে সেখানে তরী বেয়ে এক মাঝির আগমন হয়। তরীটিকে দেখার পর কৃষকের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়। সংকট থেকে উত্তরণের নতুন সম্ভাবনা উদিত হয় তাঁর মনে ।
প্রশ্ন-৯. “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী'— বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: প্রশ্নোক্ত চরণটিতে মহাকালের প্রতীক সোনার তরীতে মানুষের কর্মের স্থান হলেও সেখানে ব্যক্তিমানুষের যে স্থান হয় না, সে বিষয়টিই ফুটে উঠেছে।
ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু অনিবার্য; তাকে রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যক্তির কর্মফল বা অর্জনকে মৃত্যু স্পর্শ করতে পারে না। আর তাই সোনার তরীতে কেবল কৃষকের সোনার ধানই ঠাঁই পায়, কিন্তু ব্যক্তিকৃষককে অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় অনিবার্যভাবে মহাকালের স্রোতে বিলীন হওয়ার জন্য ।
মানুষ তার কর্মকে রেখে যায়, মানুষের স্থান হয় না এ নশ্বর পৃথিবীতে। প্রশ্নোক্ত চরণটিতে ঠাঁই নাই কথাটির মাধ্যমে জীবনের এই অমোঘ সত্যটিকেই তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন-১০. ‘আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি'— এ উক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে কবি কৃষকের কর্মফল সোনার ধানে মহাকালের তুরী পরিপূর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে ।
‘সোনার তরী' একটি রূপক কবিতা। এ কবিতায় কৃষকরূপী শিল্পস্রষ্টা কবি তাঁর সৃষ্টিকর্ম সোনার ধান নিয়ে মহাকালরূপী তরীর প্রতীক্ষায় ছিলেন । তরী আসার পর ধানরূপী তাঁর সমস্ত কর্ম সেখানে তুলে দেন ।
এ সময় তিনি উপলব্ধি করেন তাঁরই কর্মের ভারে পূর্ণ তরীতে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার মতো স্থান অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ তরীরূপী মহাকাল শুধু ফসল অর্থাৎ মানুষের কর্মকেই গ্রহণ করবে, ব্যক্তি মানুষকে নয়। প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন-১১. 'শ্রাবণগগন ঘিরে / ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে'- উক্তিটিতে বর্ষার কোন রূপ ধরা পড়েছে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উদ্ধৃতাংশটিতে শ্রাবণের ঘনঘোর বর্ষার চিরায়ত রূপটিই ধরা পড়েছে।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল হলেও শ্রাবণ মাসেই বর্ষার প্রকৃত রূপটি ধরা দেয়।
সে সময় দিনের বেশিরভাগ সময় আকাশ কালো মেঘে ঢাকা থাকে। যেকোনো মুহূর্তেই বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। উদ্ধৃতাংশটির মধ্য দিয়ে বাংলার বর্ষাকালের চিরাচরিত এই রূপটিই অঙ্কন করেছেন কবি।
প্রশ্ন-১২. 'সোনার তরী' কবিতায় মানবজীবনের কোন দিকটি বিবৃত হয়েছে? বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: 'সোনার তরী' কবিতায় নশ্বর মানবজীবনের বিপরীতে কর্মের অমরতার দিকটি বিবৃত হয়েছে।
মানুষের জীবন নশ্বর, মৃত্যু তার অনিবার্য পরিণতি। তবে মানুষের মহৎ কর্মের মৃত্যু নেই। মহাকালের তরীতে ব্যক্তিমানুষ স্থান না পেলেও মহাকাল তার কর্মকে গ্রহণ করে ঠিকই।
আলোচ্য কবিতাটিতে মানবজীবনের এই গূঢ় সত্যটিই কৃষক ও তাঁর সোনার ফসলের পরিণতির মধ্যদিয়ে ফুটে উঠেছে।