২২টি বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর
২২টি বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর |
২২টি বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর | bidrohi kobita question answer
প্রশ্ন-১. কবি নিজেকে মহাভয় বলে অভিহিত করেছেন কেন?
উত্তর: অন্যায়-অবিচার নিয়ে অপশক্তির মনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যেই কবি নিজেকে 'মহাভয়' বলে অভিহিত করেছেন।
পরাধীন ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত শোষিত, বঞ্চিত ও অত্যাচারিত হতে দেখেছেন কবি। এভাবে মানুষকে নিপীড়িত হতে দেখে সংক্ষুব্ধ হয়ে কবি বিদ্রোহের পথ বেছে নেন ।
এরই ধারাবাহিকতায় অন্যায় ও অসাম্য ঘোচাতে অত্যাচারীর মনে তিনি ভীতির সঞ্চার করতে চান । এ লক্ষ্যে সকল অপশক্তির মনে ভয় হিসেবে আবির্ভূত হতে চান তিনি। এ জন্যই কবি নিজেকে 'মহাভয়' বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রশ্ন-২. ‘আমি দুর্বার/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার'- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: আলোচ্য উক্তিতে কবির বিধ্বংসী রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে “বিদ্রোহী' কবিতায় কবি শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।
পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের অপশাসন ও ভেদ-বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশবাসীকে তিনি মুক্ত করতে চান।
এ লক্ষ্যেই দুর্বার গতিতে তিনি শোষক ও অত্যাচারীর সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে চান। প্রশ্নোক্ত চরণটিতে বিদ্রোহী কবিসত্তার এমন বিধ্বংসী রূপই প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রশ্ন-৩. .আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন'— ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত চরণটির মধ্যদিয়ে কবির ধ্বংসকামী মানসিকতার ভয়াবহ রূপটি ফুটে উঠেছে ।
অন্যায় ও অসাম্যকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কবি অপশক্তিকে ধ্বংস করতে চান । এ লক্ষ্যে নিজেকে তিনি নানা বিধ্বংসী রূপে কল্পনা করেছেন।
এরই ধারাবহিকতায় তিনি অত্যাচারীর ভরা-তরী তথা সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেবেন এবং টর্পেডো ও মাইনের মতো বিধ্বংসী অস্ত্ররূপে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন, তা বোঝাতেই কবি বলেছেন, 'আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন'
প্রশ্ন-৪. কবি নিজেকে ধূর্জটি বলেছেন কেন?
উত্তর: কবি অপশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়ে ধ্বংসের দেবতা শিবের ধূর্জটি রূপে নিজেকে কল্পনা করেছেন ।
পরাধীন ভারতবর্ষে বিরাজমান অন্যায় ও অসাম্য প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত কবি এর বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করেন। অপশক্তিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেকে তিনি নানা পৌরাণিক ধ্বংসকারী চরিত্রে কল্পনা করেছেন।
ধূম্ররূপী জটাধারী শিব বা মহাদেবকে ধূর্জটি বলা হয়। শিবের এই সংহারক রূপটিকে অবলম্বন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি অভিশাপ হয়ে নেমে আসতে চান। এজন্যই কবি নিজেকে ধূর্জটি বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রশ্ন-৫. কবি নিজেকে 'ইন্দ্রাণী-সুত' বলেছেন কেন?
উত্তর: নিজেকে ‘ইন্দ্রাণী-সুত' তথা জয়ন্ত-এর মতো যোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করে কবি নিজেকে ‘ইন্দ্রাণী-সুত' বলেছেন।
“বিদ্রোহী' কবিতায় বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দিতে ধর্ম, ঐতিহ্য; ইতিহাস ও পুরাণের শক্তি উৎস থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। ইন্দ্রাণী-সুত জয়ন্ত একটি পৌরাণিক যোদ্ধা চরিত্র। দেবরাজ ইন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী শচী বা ইন্দ্রাণীর সন্তানও জয়ন্ত।
ইনি রাবণের স্বর্গাভিযানকালে বিক্রমের সাথে যুদ্ধ করে রাক্ষসসেনাদের পরাস্ত করেন। কবিও তাঁর সময়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে নিজেকে জয়ন্তরূপী বীর যোদ্ধা মনে করেছেন। তাই তিনি নিজেকে ‘ইন্দ্ৰাণী-সুত’ বলেছেন ।
প্রশ্ন-৬. ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ'- ব্যাখ্যা করো ।
উত্তর: ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ' কথার দ্বারা আত্মজাগরণে উন্মুখ কবির সদম্ভ আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী' কবিতায় কবি বিদ্রোহী হিসেবে নিজের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। মানবপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বিদ্রোহ করেছেন অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
আপন আদর্শে স্থিত কবির এই বিদ্রোহী সত্তা স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভীক। সংগত কারণেই কারও কাছে মাথা নত করেন না তিনি । প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে ।
প্রশ্ন-৭. ‘আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল'- ব্যাখ্যা করো ।
উত্তর: কবি নিজেকে শিব বা মহাদেবের হাতের ডমরু ও ত্রিশূলরূপে নিজেকে কল্পনা করে আলোচ্য উক্তির অবতারণা করেছেন।
‘বিদ্রোহী' কবিতায় কবি তাঁর বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে নানা পৌরাণিক চরিত্র ও অস্ত্রের প্রসঙ্গ টেনেছেন। প্রশ্নোক্ত পিণাক-পাণি’ ধ্বংসের দেবতা শিব কর্তৃক ব্যবহৃত তেমনি এক পৌরাণিক অস্ত্র। এগুলো ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
নৃত্যের তালে তালে ডমরু বাজে আর চূড়ান্ত আঘাত হানা হয় ত্রিশূল দিয়ে। কবি নিজেকে সেই ডমরু আর ত্রিশূলরূপে বর্ণনা করে মূলত অপশক্তি বিনাশের বার্তা দিতে চেয়েছেন ।
প্রশ্ন-৮. কবি নিজেকে ধর্মরাজের দণ্ড বলেছেন কেন?
উত্তর: ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তুলে ধরতেই কবি নিজেকে ধর্মরাজের দণ্ড বলেছেন।
দেবগণের মধ্যে যম সর্বাপেক্ষা পুণ্যবান বলে তাঁর নাম ধর্মরাজ। তিনি নিরপেক্ষভাবে জীবের পাপ-পুণ্যের বিচার করেন। তাঁর হাতের দণ্ডই ধর্মরাজের দণ্ড। মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবিও তেমনি ন্যায়ের প্রতিমূর্তি।
বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের ন্যায়ের পক্ষেই তাঁর দ্রোহ। সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার যোগ্য শান্তি বিধান করার মানসে নিজেকে তিনি ধর্মরাজের দণ্ডের সাথে তুলনা করেছেন।
প্রশ্ন-৯. কবি নিজেকে 'ক্ষ্যাপা দুর্বাসা' বলেছেন কেন?
উত্তর: কবি বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে অপশক্তির প্রতিভূদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে নিজেকে ‘ক্ষ্যাপা দুর্বাসা' বলেছেন।
পুরাণ মতে, দুর্বাসা অত্যন্ত কোপন-স্বভাব বিশিষ্ট একজন মুনি ! অনেকেই তাঁর কোপানলে দগ্ধ হন। ইনি তাঁর স্ত্রীকে শাপ দিয়ে ভস্ম করেন। তাঁর শাপে দেবরাজ ইন্দ্রও শ্রীভ্রষ্ট হন। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে দুর্বাসা অনেক সময় উন্মত্তের মতো কাজ করতেন।
ফলে দেবতারা পর্যন্ত তাঁকে ভয় পেতেন। আলোচ্য কবিতায় কবি বিদ্রোহী হিসেবে অন্যায় ও অসাম্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যেই নিজেকে ‘ক্ষ্যাপা দুর্বাসা' বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রশ্ন-১০. কবি নিজেকে 'বিশ্বামিত্র শিষ্য' বলেছেন কেন?
উত্তর: কবি বিদ্রোহকে কঠোর সাধনার বিষয় গণ্য করে পৌরাণিক তপস্যি ঋষি বিশ্বামিত্রের শিষ্য হিসেবে আত্মপরিচয় দান করেছেন। পুরাণ মতে, ঋষি বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম নিলেও একপর্যায়ে যুদ্ধ- বিগ্রহের প্রতি বিরাগভাজন হন।
তখন থেকে তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভের জন্য কঠোর সাধনা ও তপস্যা শুরু করেন এবং একপর্যায়ে সফল হন। কবি বিদ্রোহকে তেমনি এক সাধনা বা তপস্যা হিসেবেই নিয়েছেন।
ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে এ তপস্যায় লেগে না থাকলে সফলতা ধরা নাও দিতে পারে। তাই কবি বিশ্বামিত্রকে গুরু মেনে নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন-১১. 'আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব' – ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কবি দাবানল-দাহ তথা ভয়ানক অগ্নিপ্রবাহরূপে নিজেকে কল্পনা করে অশুভ শক্তির তৈরি অসাম্যের পৃথিবীকে দাহন বা ধ্বংস করার মানসে আলোচ্য উক্তির অবতারণা করেছেন।
‘বিদ্রোহী' কবিতায় কবি অপশক্তির ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন এক বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী বিনির্মাণ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ভয়ংকর অগ্নিপ্রবাহ বা দাবানলের দাহ্য ক্ষমতারূপে নিজেকে কল্পনা করেছেন।
এরই অংশ হিসেবে তিনি অপশক্তি প্রভাবিত জগৎকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে ঈন্সিত সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
প্রশ্ন-১২. 'আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর'— ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত চরণটির মধ্যদিয়ে পীড়িত মানুষের প্রতি কবির সহমর্মিতা ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে।
মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছেন বলেই কবি যথার্থ বিদ্রোহী হতে পেরেছেন। মানুষের প্রতি অপার ভালোবাসাই কবির দ্রোহের মূলসুর। বস্তুত, কবির এই দ্রোহ মানবমুক্তির লক্ষ্যেই চালিত।
এ কারণেই স্বামীহারা নারী তথা বিধবার ক্রন্দনের অন্তর্নিহিত বেদনা বা যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের হা-হুতাশকে অনুভব করেছেন তিনি। প্রশ্নোক্ত চরণটিতে পীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর সেই সহানুভূতি ও সহমর্মিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
প্রশ্ন-১৩, কবি নিজেকে ‘বঞ্চিত ব্যথা' বলেছেন কেন?
উত্তর: পথবাসী গৃহহারা পথিকের ব্যথা-যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে সহমর্মিতা প্রকাশ করতেই কবি নিজেকে 'বঞ্চিত ব্যথা' বলেছেন।
কবি বিদ্রোহী হয়েছেন মূলত একটি শোষণ-বঞ্ছনাহীন ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী বিনির্মাণের লক্ষ্যে। তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাকে দরদি মন নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে নিজেকে তিনি শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের একজন কল্পনা করে তাদের ব্যথা-বেদনাকে উপলব্ধি করেছেন।
নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম ভালোবাসাই কবিকে বিদ্রোহের পথে ধাবিত করেছে। এরই অংশ হিসেবে নিজেকে বঞ্চিতের ব্যথা অভিহিত করে আর্তমানবতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন কবি।
প্রশ্ন-১৪. ‘আমি পথিক কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত চরণটির মধ্য দিয়ে কবির প্রেমভাব এবং নিজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে ।
কবি একই সঙ্গে প্রেম ও দ্রোহের প্রতিমূর্তি। অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে দ্রোহ করার পাশাপাশি তিনি মানবপ্রেমেরও ধারক। তাছাড়া কবি মনেপ্রাণে পুরোদস্তুর বাঙালি। বাঙালি সংস্কৃতি তাঁর অস্তিত্বের সাথে জুড়ে রয়েছে।
পথিক কবির সৃষ্টিকর্ম ও বাঁশির সুর আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। আলোচ্য অংশে নিজেকে সেই সুরের সঙ্গে একাত্ম করে কবি তার প্রতি নিজের অনুভব ও ভালোবাসাকে ব্যক্ত করেছেন।
প্রশ্ন-১৫. ‘আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি' ব্যাখ্যা করো ।
উত্তর: বাংলার গ্রীষ্ম ঋতুর রুদ্র রূপের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি বলেছেন, ‘আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি।'
ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ঋতুপরিক্রমার সূত্র ধরে এদেশে প্রথমেই আবির্ভাব ঘটে রবির কিরণে উজ্জ্বল গ্রীষ্মকালের। এসময় রোদের তীব্রতায় চারদিকে যেন অগ্নিবর্ষণ হয় । সংগত কারণেই এ ঋতু বাংলাদেশের মানুষকে করেছে সংগ্রামী এবং প্রবল কষ্টসহিষ্ণু।
কবি তাদেরই একজন। তাই তিনি দ্রোহের বাণী উচ্চারণ করতে গিয়ে গ্রীষ্মের রুদ্ররূপের মাঝে যেন নিজেকেই খুঁজে পান। প্রশ্নোক্ত চরণটিতে কবির সে অনুভবই ব্যক্ত হয়েছে ।
প্রশ্ন-১৬. 'আমি মরু-নির্ঝর ঝরঝর'- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মরুভূমির বুকে এক টুকরো ঝরনাধারার ন্যায় কবি বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিশা দেখাতে এসেছেন বোঝাতেই কবি প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
মানুষ যেন শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচার-নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পায়, সে লক্ষ্যেই কবির নিরন্তর দ্রোহ-সংগ্রাম।
কিন্তু পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জন্মভূমিতে কবির প্রত্যাশিত সেই সমাজ যেন মরুভূমির মাঝে ঝরনার দেখা পাওয়ার মতোই প্রায় অসম্ভব বিষয়। কিন্তু কবি সে অসম্ভবকেই সম্ভব করতে চান। বিষয়টিকে বোঝাতেই নিজেকে তিনি মরু-নির্ঝর বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন-১৭. 'আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্যদিয়ে কবি বাংলার প্রকৃতির শ্যামল-কোমল- মোহনীয় রূপে নিজেকে কল্পনা করেছেন ।
সবুজে-শ্যামলে ছাওয়া আমাদের এই দেশ। যেদিকে দুচোখ যায় সবুজ আর সবুজ; যেন পটে আঁকা ছবি। ভর দুপুরে গাছের ছায়ায় যে আলো- আঁধারের খেলা চলে তা তুলনারহিত। কবি বাংলাদেশের প্রকৃতির এই চিরায়ত রূপটি তাঁর হৃদয়ে ধারণ করেন।
অর্থাৎ মাতৃভূমির প্রকৃতির প্রতি রূপমুগ্ধতা ও গভীর অনুরাগ থেকেই কবি প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
প্রশ্ন-১৮. ‘আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া'- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কবি রুদ্ররূপ ধারণ করলে কী ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তা বোঝাতেই তিনি আলোচ্য পক্তিটির অবতারণা করেছেন ।
আলোচ্য কবিতায় কবি নানা অনুষঙ্গে ভর করে তাঁর দ্রোহের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কবি মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে নেমে আসতে চান। আর তা করতে গিয়ে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন বিধ্বংসী রূপে।
তাঁর এই বিধ্বংসী রূপ দেখে যেন শত্রুর বুকে কাঁপন ধরে যায়। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত সপ্ত নরক এবং হাবিয়া দোজখের আগুনও যেন কেঁপে উঠে নিভে যায়। এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নোক্ত চরণটিতে কবির দ্রোহের ধ্বংসাত্মক রূপটিই প্রতিভাত হয় ।
প্রশ্ন-১৯. কবি নিজেকে 'পরশুরামের কঠোর কুঠার' বলেছেন কেন?
উত্তর: কবি তাঁর দ্রোহের বিধ্বংসী রূপটি প্রকাশ করতেই নিজেকে পরশুরামের কুঠার বলে অভিহিত করেছেন।
পৌরাণিক চরিত্র পরশুরাম শ্রীকৃষ্ণের বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। তিনি পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়মুক্ত করতে তাঁর কুঠারের মাধ্যমে একুশবার ক্ষত্রিয়দের নিধন করেন। কবি নিজেকে পরশুরামের সেই কুঠাররূপে কল্পনা করে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে অপশাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন ।
প্রশ্ন-২০. 'আমি হল বলরাম স্কন্ধে' – কবি এ কথা বলেছেন কেন ?
উত্তর: অন্যায়-অত্যাচার ধ্বংসকল্পে কবি নিজেকে পুরাণে বর্ণিত অন্যতম বীর যোদ্ধা বলরামের বিধ্বংসী অস্ত্র হল বা লাঙলরূপে উপস্থাপন করেছেন।
বলরাম মহাভারতে বর্ণিত অন্যতম বীর যোদ্ধা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাও বটে। তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল হল বা লাঙল। এই হল ব্যবহার করেই তিনি কৌরবদের প্রধান নগরী ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
আলোচ্য কবিতাটিতে কবি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজের বিধ্বংসী মনোভাবকে উপস্থাপন করতেই প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
প্রশ্ন-২১. 'আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নবসৃষ্টির মহানন্দে’— ব্যাখ্যা করো ।
উত্তর: সৃষ্টির লক্ষ্যে ধ্বংস— সেই প্রেরণা থেকেই কবি প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন ।
'বিদ্রোহী' কবিতায় কবির ধ্বংসকামী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তবে কবির এ ধ্বংসাত্মক রূপের বিপরীতে একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তা হলো একটি শোষণ ও বঞ্চনাহীন শান্তিপূর্ণ পৃথিবী বিনির্মাণ করা।
অর্থাৎ তিনি ধ্বংস করতে চান নতুন সৃষ্টির অভিপ্রায়ে। আলোচ্য চরণে কবি নিজেকে রুদ্ররূপে কল্পনা করে অপশক্তির অধীনস্থ পৃথিবীকে সমূলে উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন। আর এ কাজ তিনি করবেন নবসৃষ্টির মহানন্দ নিয়ে। এভাবে আলোচ্য চরণটিতে কবির বিদ্রোহের স্বরূপ এবং তার লক্ষ্যই উঠে এসেছে।
প্রশ্ন-২২. কবি নিজেকে 'চির-বিদ্রোহী বীর' বলেছেন কেন?
উত্তর: চিরকালীন বিদ্রোহের ঝান্ডাধারী বীরপুরুষ হিসেবে পরিচয় জ্ঞাপন করতে গিয়ে নিজেকে কবি 'চির-বিদ্রোহী বীর' বলে অভিহিত করেছেন। কবি সাম্যচেতনাকে ধারণ করেন।
আর তাই যেখানেই তিনি অন্যায় ও অসাম্য দেখেছেন, প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন তার বিরুদ্ধেই। একই কারণে পরাধীন ভারতবর্ষে চারপাশের অন্যায়-নিপীড়ন ও বৈষম্য প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত কবি উচ্চারণ করেন দ্রোহের পক্তিমালা।
কবির এ দ্রোহ কোনো স্থান-কাল বা সীমার গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে বৈষম্যহীন ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। এই অনুভব থেকেই কবি নিজেকে চির-বিদ্রোহী বীর বলে অভিহিত করেছেন।