কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম | কুরআনের সিজদা করার নিয়ম
পবিত্র কুরআন হচ্ছে বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত অশেষ নিয়ামত। যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর পরিচয় এবং বিশ্বজাহান সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন।
যেখানে তিনি মানুষের জন্য করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়াদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি মুসলমানকেই এই কুরআন পড়তে এবং জানতে হবে।
কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম কুরআনের সিজদা করার নিয়ম |
এই কুরআনে আল্লাহ তা আলা এমন এমন কিছু আয়াত দিয়েছেন, যেসব আয়াত কেউ তেলাওয়াত করলে ঐ তেলাওয়াতকারী এবং শ্রবণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহকে সিজদা করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলমানই জানে না কোরআন শরীফের সিজদা করার নিয়ম অথবা কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম।
কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম | কোরআন শরীফের সিজদা করার নিয়ম
আমরা অনেকেই কুরআনের সিজদা করার নিয়ম জানি না বলে অনেক গুনাহগার হচ্ছি। শুধু তাই আমরা যারা কুরআন পড়ি তারা কোরআন শরীফের সিজদা করার নিয়ম মোটামুটি জানলেও যারা কুরআন পড়ি না কিংবা পড়তে জানি না তারাও কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম জানি না।
অর্থাৎ পরিষ্কার কথা হচ্ছে, পবিত্র কুরআনে মোট ১৫টি আয়ত রয়েছে। যখন আমরা কুরআন পড়ি কিংবা শুনি। তখন যখনই এই আয়াত গুলো আসবে তখনই উভয়েরই সিজদা দেওয়া ওয়াজিব। এইসব সিজদা সমূহকে বলা হয় তেলাওয়াতের সিজদা।
এটা প্রতিটি মানুষের জন্য আল্লাহর একটি আইন। আর আমরা সবাই জানি ওয়াজিব ত্যাগ করা হচ্ছে কবীরা গুনাহ। তাই এই কবীরাহ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাটা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর একটি দায়িত্ব। আমাদের দেশে পবিত্র রমজান মাসে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানই কুরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে পুরো কুরআন মাজীদ খতম করে থাকেন।
সুতরাং যারা নিজেরা কুরআন সম্পূর্ণ তেলাওয়াত করবে, তাদেরকে অবশ্যই কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম জানতে হবে। একইসাথে আমরা যারা কুরআনের তেলাওাত শুনবো, তারাও সাথে সাথে সিজদা দেওয়ার চেষ্টা করব।
এই সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করলে অথবা শুনলে তকবীর দিয়ে একটি সিজদাহ দেওয়া এবং তকবীর দিয়ে মাথা তোলা মুস্তাহাব। এই সিজদার পরে কোন তাশাহুদ বা সালাম নেই।
এই সিজদাহ করার মধ্যে বড় ফযীলত ও মাহাত্ম রয়েছে। রাসুল সাঃ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করে, তখন শয়তান দূরে সরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘হায় ধ্বংস আমার! ও সিজদাহ করতে আদেশ পেয়ে সিজদাহ করে, ফলে ওর জন্য রয়েছে জান্নাত। আর আমি সিজদার আদেশ পেয়ে তা অমান্য করেছি, ফলে আমার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৯৫নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
তেলাওয়াতের সিজদা কুরআন তেলাওয়াতকারী ও শ্রোতার জন্য সুন্নত। ‘উমর ইব্নু খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিতঃ, তিনি এক জুমু’আর দিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে সুরা নাহল তেলাওয়াত করেন।
এতে যখন সিজদার আয়াত এল, তখন তিনি মিম্বর হতে নেমে সিজদা করলেন এবং লোকেরাও সিজদা করল। এভাবে যখন পরবর্তী জুমু’আ এল, তখন তিনি সে সুরা পাঠ করেন।
এতে যখন সিজদার আয়াত এল, তখন তিনি বললেন, হে লোক সকল! আমরা যখন সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করি, তখন যে সিজদা করবে সে ঠিকই করবে, যে সিজদা করবে না তার কোন গুনাহ নেই।
তার বর্ণনায় (বর্ণনাকারী বলেন) আর ‘উমর (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) সিজদা করেননি। নাফি’(রহঃ) ইব্নু ‘উমর (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) হতে আরো বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা সিজদা ফরয করেননি, তবে আমরা ইচ্ছা করলে সিজদা করতে পারি।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০৭৭)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, যে হাদিস যায়দ ইবনু সাবিত (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে সুরা ওয়ান্-নাজ্ম তেলাওয়াত করলাম। এতে তিনি সিজদা করেননি। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০৭৩)
কুরআন তেলাওয়াতের সিজদার আয়াত সমূহ
১. সুরা আ’রাফ : আয়াত নং ২০৬
২. সুরা রা’দ : আয়াত নং ১৫
৩. সুরা নহল : আয়াত নং ৫০
৪. সুরা বনী ইসরাঈল : আয়াত নং ১০৯
৫. সুরা মারিয়াম : আয়াত নং ৫৮
৬. সুরা হাজ : আয়াত নং ১৮
৭. সুরা হাজ : আয়াত নং ৭৭ (শাফী)
৮. সুরা ফুরক্বান : আয়াত নং ৬০
৯. সুরা নমল : আয়াত নং ২৬
১০. সুরা সাজদাহ : আয়াত নং ১৫
১১. সুরা সা’দ : আয়াত নং ২৪ (হানাফী)
১২.সুরা হামীম সাজদাহ : আয়াত নং ৩৮
১৩. সুরা নজম : আয়াত নং ৬২
১৪. সুরা ইনশিক্বাক্ব : আয়াত নং ২১
১৫. সুরা আলাক্ব : আয়াত নং ১৯।
কিভাবে সিজদাহ আদায় করতে হয়
পরিষ্কার নিয়তের সাথে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে "আল্লাহু আকবার" বলে সরাসরি সিজদায় চলে যেতে হবে। একইসাথে নামাজের সিজদার মতো “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” তিনবার পড়তে হবে। তাসবিহ পড়ে আবার "আল্লাহু আকবার" বলে সিজদা থেকে উঠে যেতে হবে।
যদি একের অধিক সিজদার আয়াত পাঠ করে একাধিক সিজদা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ যে কয়টি আয়াত তেলাওয়াত করবে সে কয়টি সিজদা আদায় করতে হবে।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ম হ’ল- প্রথমে তাকবীর দিয়ে সিজদায় যাবে। অতঃপর দো‘আ পড়বে এবং পুনরায় তাকবীর দিয়ে মাথা উঠাবে (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হাদিস /৫৯৩০; বায়হাক্বী ২/৩২৫, সনদ ছহীহ; তামামুল মিন্নাহ ২৬৯ পৃ.)।
সিজদা মাত্র একটি হবে। এতে তাশাহহুদ নেই, সালামও নেই (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৬৪)।
নামায আদায়ের সময় তেলাওয়াতের সিজদাহ আসলে একাকী বা ইমাম সকলের জন্য নামাযে সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করলে তখন সকলের জন্য সিজদাহ করা সুন্নত। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১/২৭০পৃ:) কারণ, এতে মুক্তাদীদের মাঝে গোলমাল সৃষ্টি হয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩২৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/৩০০)
একইসাথে মুক্তাদীর জন্য ইমামের অনুসরণে সিজদাহ করা জরুরী। যেমন, সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করে যদি ইমাম সিজদাহ না করেন, তাহলে মুক্তাদীও সিজদাহ করতে পারে না।
শুধু তাইনয় একই সঙ্গে কয়েকটি সিজদার আয়াত পড়লে সবশেষে একটি সিজদা করাই যথেষ্ট। যেমন মাদ্রাসায় হিফয করার সময় পবিত্র কুরআনের সিজদার আয়াত বারবার পড়লেও সবশেষে একটি সিজদাহ করে নেওয়াই যথেষ্ট।
সিজদার আয়াত তেলাওাত বা শ্রবণ করার পরও সিজদাহ করার সুযোগ সুবিধা না হলে সামান্য পরে হলেও সিজদাহ কাযা করে নেওয়া যাবে। তবে দেরী বেশী হয়ে গেলে কাযা করা যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্ আরবী ১/১৯৮)
একইসাথে এই তেলাওয়াতে সিজদা আদায়ের পরে হাত তুলে মুনাজাত করা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ২৮০পৃ:)
কারা সিজদাহ আদায় করবে
১. অধিকাংশ সময় রমজানের তারাবীতে আমাদের দেশে খতমে কুরআন দেওয়া হয়। তখন নামাজের মধ্যে যখন সিজদার আয়াত আসে এবং হুজুর তেলাওয়াত করার সাথে সাথেই সবাইকে সিজদায় চলে যেতে হবে। সিজদা দেওয়া শেষ হলে আবার দাঁড়িয়ে পরবর্তী আয়াত পড়ে বাকি নামাজ শেষ করতে হবে।
২. এছাড়াও আমরা যখন ঘরে কিংবা যেকোনো জায়গায় কুরআন পড়ি, তখন যদি পড়ার সময় কোনো সিজদার আয়াত আসে। তাহলে যে পড়বে সে যদি জানে এটা সিজদার আয়াত, তবে তাকে সাথে সাথে সিজদা আদায় করতে হবে।
আর তার আশেপাশে কেউ যদি সেই কুরআন তেলাওয়াত শ্রবন করে এবং সে যদি জানে যে, এ আয়াতটি সিজদার আয়াত তবে তাকেও সিজদা আদায় করতে হবে।
৩. কেউ যদি আরবিতে কুরআন না পড়ে অন্য ভাষাও কুরআনের অর্থ পড়ে, এবং সে যদি জানে যে এটা সিজদার আয়াত। তাহলে তাকেও তেলাওয়াতের সিজদার হক তথা সিজদা আদায় করতে হবে।
একইসাথে কেউ যদি ঐ ব্যাক্তির কুরআন পড়া শ্রবণ করে, এবং সে যদি জানে যে এটা সিজদার আয়াত, তাহলে তাকেও সিজদা আদায় করতে হবে (যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে)।
কারা সিজদাহ আদায় করব না
১. নাবালক শিশু, মস্তিষ্কবিকৃত মানুষ তথা মানসিক ভারসাম্যহীন (পাগল), হায়েজ (ঋতুস্রাব চলাকালীন অবস্থায়) নিফাসকালীন (সন্তান প্রবস পরবর্তী তিন মাস সময়) সময়ে, অমুসলিম কাফের ব্যক্তি, যাদের ঈমান নেই তারা যদি সিজদার আয়াত শ্রবন করে তবে তার উপর সিজদা আদায় করার হুকুম নেই। অন্যদিকে এইসব অমুসলিম কাফেরদের থেকে যদি কোনো মুসলিম সুস্থ ও সাবালক লোক পবিত্রাবস্থায় সিজদার আয়াত শোনেন এবং বুঝতে পারেন যে এটা সিজদার আয়াত তবে তাদেরকে সিজদা আদায় করতে হবে।
২. যদি কেউ সিজদার আয়াত তেলাওয়াতের ভঙ্গিতে না পড়ে শুধু বানান করে করে সিজদার আয়াত এক অক্ষর এক অক্ষর করে পড়ে, তাহলে পড়া এবং শোনা উভয়ই ব্যক্তিকেই সিজদা আদায় করতে হবে না।
সিজদাহর শর্ত সমূহ
১. অবশ্যই সর্বাবস্থায় পাক পবিত্রতার মাধ্যমে সিজদা আদায় করতে হবে।
২. সিজদার দেওয়ার আগে সতরে আওরাত তথা নামাজের মতোই পোশাক পরিচ্ছেদ পরিধানে থাকতে হবে।
৩. সিজদা অবশ্যই কিবলামুখী হয়ে কিবলার দিকেই আদায় করতে হবে। একইসাথে সিজদা স্থানও নামাজের মতো পাক পবিত্র হতে হবে।
৪. অবশ্যই অন্তরে নিয়ত থাকতে পবিত্র কুরআনের তেলাওয়াতের সিজদা আদায়ের।
৫. এই সিজদা আদায়ের জন্য সিজদাকারীকে তাকবীর বলে দু’হাত উঠিয়ে নামাজের মতো হাত বাঁধতে হবে না।
৬. এই সিজদায় কোনো রুকু নেই। তাই রুকু না করে সরাসরি সিজদায় চলে যেতে হবে।
৭. সিজদার আয়াত যদি একটি হয় তাহলে তেলাওয়াতে একটি সিজদাই আদায় করতে হবে। নামাজের মতো দুই সিজদার প্রয়োজন নেই।
৮. একস্থানে দীর্ঘক্ষণ থাকলে এ সিজদা সঙ্গে সঙ্গে না করে কিছু পরেও করা যায়। স্থান পরিবর্তন হ’লে আর সিজদা করতে হয় না, ক্বাযাও আদায় করতে হয় না। এই সিজদা করলে নেকী আছে, না করলে গোনাহ নেই (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২২৪ পৃ.)।
উপরোল্লিখিত ১৫টি তেলাওয়াতের সিজদার আয়াতগুলো পড়লে কিংবা শুনলে আমাদের প্রত্যেককে সিজদা আদায় করতে হবে। আদায় না করলে আমাদেরকে গুনাহগার হতে হবে।
আল্লাহ তা আলা আমাদেরকে সিজদার আয়াতগুলো তেলাওয়াতের সাথে সাথে সিজদা আদায় করে তাঁর হক পালনের তৌফিক দান করুন আমীন।
তেলাওয়াতে সিজদায় কি অজু জরুরী ?
তেলাওয়াতের সিজদার আদায়ের জন্য অজুর কোনো শর্ত নেই। সতর ঢাকা অবস্থায় কেবলামুখে এই সিজদাহ করা যায়। (নাইলুল আউতার, শাওকানী, আলমুমতে’, শারহে ফিকহে ইবনে উসাইমিন ৪/১২৬, ফিকহুস সুন্নাহ আরবী ১/১৯৬)
তেলাওয়াতের সিজদার দোয়া কী কী
سَجَدَ وَجْهِىَ لِلَّذِيْ خَلَقَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ بِحَوْلِهِ وَقُوَّتِهِ।
বাংলা উচ্চারণ: সাজাদা অজহিয়া লিল্লাযী খালাক্বাহু অশাক্বক্বা সামআহু অবাস্বারাহু বিহাউলিহী অক্বুউওয়াতিহ্।
বাংলা অর্থ: আমার মুখমন্ডল তাঁর জন্য সিজদাবনত হলো যিনি ওকে সৃষ্টি করেছেন এবং স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতায় ওর চক্ষু ও কর্ণকে উদগত করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, সহীহ তিরমিযী, সুনান৪৭৪নং, আহ্মদ ৬/৩০)
আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, এই দোয়া সিজদায় একাধিকবার পাঠ করতে হয়।
২- اَللّهُمَّ اكْتُبْ لِيْ بِهَا عِنْدَكَ أَجْراً، وَّضَعْ عَنِّيْ بِهَا وِزْراً، وَّاجْعَلْهَا لِيْ عِنْدَكَ ذُخْراً، وَّتَقَبَّلْهَا مِنِّيْ كَمَا تَقَبَّلْتَهَا مِنْ عَبْدِكَ دَاوُوْدَ।
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাকতুব লী বিহা ইন্দাকা আজরা, অযা’ আন্নী বিহা বিযরা, অজআলহা লী ইন্দাকা যুখরা, অতাক্বাব্বালহা মিন্নী কামা তাক্বাব্বালতাহা মিন আবদিকা দাঊদ।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! এর (সিজদার) বিনিময়ে তোমার নিকট আমার জন্য পুণ্য লিপিবদ্ধ কর, পাপ মোচন কর, তোমার নিকট এ আমার জন্য জমা রাখ এবং এ আমার নিকট হতে গ্রহণ কর যেমন তুমি তোমার বান্দা দাঊদ (আহমাদ, মুসনাদ) থেকে গ্রহণ করেছ। (সহীহ তিরমিযী শরিফ, সুনান ৮৭ নং হাদিস, হাকেম১/২১৯, ইবনে মাজাহ ১০৫৩নং)
তেলাওয়াতের সিজদার গুরুত্ব কেন বেশী
আল্লাহ সুবহানাহু তালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কাজই করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
অথচ দুনিয়ার ভুলে শয়তানের ধোঁকায় আমরা তাঁর ইবাদত থেকে অনেক দূরে রয়েছি। অথচ মানুষকে সৃষ্টি করার সময় সকল ফিরিশতাসহ ইবলিশ শয়তানও বিরোধিতা করেছিল।
তাদের যুক্তি ছিলো, আমরা ফিরিশতারাই তো হে আল্লাহ, আপনার সব রকমের গুণগান ইবাদত বন্দেগী করি। তারপরও কেন আপনি মানুষ সৃষ্টি করবেন? ফিরিশতাদের এই কথার জবাবে আল্লাহ বলেছিলেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।।
আল্লাহ জানেন যে, ফিরিশতাদের কোনো কামনা বাসনা নেই। কিন্তু মানুষকে তিনি কামনা বাসনা দিয়েই তৈরি করেছেন। তাই এই কামনা বাসনা থাকার পরও তার বান্দারা তাঁকে সিজদা করবে ইবাদত করবে এটাই তাঁর বড় পাওয়া।
অথচ আল্লাহ যখন মানুষকে সিজদা করার জন্য ফিরিশতাদের আদেশ দিলেন, তখন ইবলিশ ছাড়া সবাই সিজদা করেছিল। আর এই ইবলিশের কাজই হচ্ছে মানুষকে নাফরমান করে আল্লাহর কাছে অপমান অপদস্থ করা।
তাই পবিত্র কুরআনের এই তেলাওয়াতে সিজদার গুরুত্ব খুবই বেশী আল্লাহর কাছে। আল্লাহ তার ফিরিশতাদের দেখিয়ে দিতে চান যে, তাঁর বান্দারা যখনই যেখানে থাকুক না কেন, তারা তাকে সিজদা করে যেকোনো উপায়ে।
এই কারণে আমাদের প্রত্যেকের উচিত কোরআন শরীফের সিজদা করার নিয়ম সম্পর্কে জানা। কেননা কুরআনের সিজদা করার নিয়ম না জানা মানেই আপনি আল্লাহ সম্পর্কে না জানা। সুতরাং আসুন আমরা কোরআন শরীফের সিজদা দেওয়ার নিয়ম সমূহ জানি এবং মেনে চলার চেষ্টা করি।
আসুন আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিজদা সম্পর্কে জানি
শুকরিয়ার সিজদাহ
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কত শত নেয়ামত দান করেছেন, তা আমরা কখনোই গুনে শেষ করতে পরবো না। এই সকল অগণিত নেয়ামতের শোকর আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য ফরয।
শোকর আদায়ের নিয়ম হল, প্রথমত: মনের মধ্যে এটা স্বীকার করে নেওয়া যে, এই নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। দ্বিতীয়ত: মুখে তার শোকর আদায় করা। তৃতীয়ত: কাজেও শোকর প্রকাশ করা।
আমরা অনেক সময় হঠাৎ করেই অনেক সুসংবাদ, সুখের খবর বা সম্পদ লাভের খবর পাই। হঠাৎ কোনো বড় বিপদ দূর হওয়ার সংবাদ শুনি। আমরা যখনই এমন সব ভালো খবর শুনি তখনই মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শোকরানার (একটি) সিজদাহ দেওয়া মুস্তাহাব বা উত্তম।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনো আনন্দদায়ক সংবাদ শুনলে অথবা শুভ সংবাদ পেলে আল্লাহ তাআলাকে শুকরিয়া জানানোর জন্য সিজদায় পতিত হতেন। (আবূদাঊদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, জামে তিরমিযী, মিশকাত হাদিস নং ১৪৯৪)
হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) যখন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে হামাযান গোত্রের লোকেদের ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কথা জানালেন, তখন তিনি সিজদাহ করলেন এবং উঠে বললেন, “হামাযানের উপর সালাম, হামাযানের উপর সালাম।” (বায়হাকী)
আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) বলেন, একদা আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বের হয়ে এক খেজুর বাগানে প্রবেশ করে সিজদায় গেলেন।
তিনি এত লম্বা সময় ধরে সিজদায় থাকলেন যে, আমি আশঙ্কা করলাম, হয়তো বা আল্লাহ তাঁর প্রাণ হরণ করে নিয়েছেন। আমি নিকটে উপস্থিত হয়ে দেখতে গেলাম।
তিনি মাথা তুলে বললেন, “আব্দুর রহ্মান! কি ব্যাপার তোমার?” আমি ঘটনা খুলে বললে তিনি বললেন, “জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে বললেন, আমি কি আপনাকে সুসংবাদ দেব না? আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আপনাকে বলেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার প্রতি দরুদ পড়বে, আমি তার প্রতি রহমত বর্ষণ করব।
আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি সালাম জানাবে, আমি তাকে শান্তি দান করব।’ এ খবর শুনে আমি আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
একইভাবে তওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ এলে কা’ব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু শুকরানার সিজদাহ করেছিলেন। (বুখারী)
এই শুকরানার সিজদার জন্য ওযূ কিংবা তাকবীর জরুরী নয়।
সহু সিজদা
সিজদায়ে সাহু বা সিজদাতুস সাহু কিংবা সাহু সিজদা। যা একটি সালাত ভুলের গুরুত্বপূর্ণ রসম। সাহু সিজদার অর্থ হলো নামাজে ভুলের সিজদা। নামাজে কোনো কারণে ভুলে কোনো ওয়াজিব ছেড়ে দিলে সিজদায়ে সাহু দিতে হয়। শুধু দিতে হয় না বরং তা তখন সিজদায়ে সাহু দেওয়া ওয়াজিব হয়ে দাঁড়ায়। মূলত সালাতে বা নামাজে কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলেই সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়।
যখন সাহু সিজদা দেওয়া ওয়াজিব
নামাজের মাধ্যে কোনো ওয়াজিব কাজ ভুলক্রমে ছুটে গেলে, সিজদায়ে সাহু দেওয়া ওয়াজিব। (বুখারি হাদিস নং ৩৮৬; আবু দাউদ হাদিস নং ৮৭৪; আল-মুজামুল আওসাত হাদিস নং ৭৮০৮)
ফরজ নামাজে ভুলক্রমে সুরা ফাতিহা পড়া না হলে, সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয়। (মুসলিম, হাদিস: ৮৯৩)
কোনো কারণে ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাতে সুরা ফাতিহার সাথে কেরাত পড়া ভুলে গেলে, শেষ দুই রাকাতে তা পড়ে নিতে হবে। তবে সিজদায়ে সাহু দিতে হবে। (মুসলিম শরিফ হাদিস নং ৮৯৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা হাদিস নং ১/৪০৯)
কেউ যদি এক সিজদা করে পরের রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তখন তাকে সাহু সিজদা দিতে হবে(প্রাগুক্ত)
তিন বা চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজে কোনো কারণে প্রথম বৈঠকে না বসে উঠে গেলে সিজদায়ে সাহু দিতে হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৮৮২)
তাশাহহুদ পড়তে ভুলে গেলে, সাহু সিজদা দিতে হবে। (নাসায়ি, হাদিস : ১২৪৩)
কোনো কারণে বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে রুকুর আগে কুনুত পড়তে ভুলে গেলে, সাহু সিজদা দিতে হবে। (বায়হাকি, হাদিস : ৪০৪২)