১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো ১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব ।
১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব |
১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব
- ১৯৪৭ সালে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব উল্লেখপূর্বক এর ব্যর্থতার কারণগুলো ব্যাখ্যা/ আলোচনা কর।
- অথবা, ১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব পরিণতি সম্পর্কে লিখ ।
- অথবা, বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব কী? এর মূল বিষয় উল্লেখপূর্বক ব্যর্থতার কারণ নিরূপণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : অখণ্ড স্বাধীন বাংলার গঠন নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর নীতি-পরিকল্পনা নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১২-২০ মে হিন্দু মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্যাপক আলোচনা করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী (বাংলার মুখ্যমন্ত্রী), আবুল হাশিম (প্রাদেশিক লীগ সেক্রেটারি), মোহাম্মদ আলী (বগুড়া, মন্ত্রী), ফজলুর রহমান (ঢাকা, মন্ত্রী), এ এম মালিক, কিরণশঙ্কর রায় (বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা), সত্যরঞ্জন বখশী, শরৎচন্দ্র বসু (ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা) প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ শরৎচন্দ্র বসুর ১ নং উডবার্ন পার্ক, কলকাতার বাসভবনে এক সম্মেলনে অখণ্ড বাংলার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর খসড়া রচনা করেন। এটিই ঐতিহাসিক 'সোহরাওয়ার্দী-বসু প্রস্তাব/ চুক্তি' নামে পরিচিত। মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম ও কংগ্রেসের বসু এতে স্বাক্ষর করেন ।
→ প্রস্তাব বা চুক্তির শর্ত তথা সংবিধানের রূপরেখা নিম্নরূপ
১. বাংলা হবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি হবে তা এই স্বাধীন রাষ্ট্র নিজেই নির্ধারণ করবে।
২. হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যানুপাতে আসন সংখ্যা বণ্টন করে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে যৌথ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলা আইন পরিষদ গঠিত হবে। হিন্দু ও তফসিলী সম্প্রদায়ের সংখ্যানুপাতে বা উভয়ের সম্মতিতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আসন সংখ্যা বণ্টিত হবে ।
৩. স্বাধীন বাংলার এরূপ পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকার মেনে নিলে বা বাংলা বিভক্ত হবে না এমন ঘোষণা দিলে বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হবে এবং তদস্থলে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। এ মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী বাদে বাকি সদস্য সমসংখ্যক মুসলিম ও হিন্দু (তফসিলীসহ) সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন হিন্দু ।
৪. নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ও পুলিশসহ সব চাকরি বাঙালিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। চাকরিতে সমসংখ্যক বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু নিয়োগ করা হবে।
৫. সংবিধান রচনার্থে ইউরোপীয় সদস্যদের বাদে আইনসভায় মুসলিম ও হিন্দু সদস্যদের নিয়ে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। গণপরিষদে মুসলিম সদস্য = ১৬ ও হিন্দু সদস্য = ১৪।
এছাড়াও আইনসভায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে সকল সম্প্রদায়ের আসন সংখ্যা নির্ধারণ ও প্রস্তাবানুসারে পুর্নিয়া (বিহার) হতে আসাম পর্যন্ত বাঙালি বৃহৎ এলাকা নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয় । বাংলার প্রস্তাবিত ৩টি অঞ্চল নিম্নরূপ :
১. মধ্য বাংলা অঞ্চল–চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও প্রেসিডেন্সি বিভাগ এবং শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) জেলা ।
২. পূর্বাঞ্চল – শ্রীহট্ট জেলা (বর্তমান সিলেট) বাদে সমগ্র আসাম এবং
৩. পশ্চিমাঞ্চল – বর্ধমান বিভাগ ও বিহারের পুর্নিয়া জেলা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, সোহরাওয়ার্দী-বসু প্রস্তাব তৈরি করা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন-
উপযুক্ত প্রস্তাবগুলো শরৎ বসু নিজেই মুসাবিদা করেন, নাকি সোহরাওয়ার্দীও সাথে ছিলেন সে কুয়াশা গবেষকরা এখনো ভেদ করতে পারেননি। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের অনেকেই সন্দেহ করেন যে, প্রস্তাবগুলো রচনার পূর্বে শরৎ বসুর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর দৈনিক আজাদ মন্তব্য করেছিল যে, শরৎ বসু যেহেতু অখণ্ড বাংলা চান না সেহেতু আন্দোলন হতে সরে যাবার জন্যই প্রস্তাবগুলো করেছেন যাতে মুসলিম লীগ এগুলো না মানে। শোনা যায় শরৎ বসু বৈঠকে প্রস্তাবগুলো সামনে এনে বলেছিলেন, এ ভেবে লীগ যদি এগুলো মেনে নেয় তবেই তিনি অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন ।
→ অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠন উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণসমূহ : বাংলার কৃতিসন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অনেক বাঙালি নেতাগণ ১৯৪৭ সালে একটি অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেন কিন্তু নানা কারণে শেষপর্যন্ত এই উদ্যোগ ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়। নিম্নে এই উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সময়ের স্বল্পতা : সময়ের স্বল্পতা অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ। কেননা বাংলাকে অবিভক্ত ও স্বাধীন রাখার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভাইসরয় সোহরাওয়ার্দীকে মাত্র দু'মাস সময় দেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বড় একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভবপর ছিল না। অখণ্ড বাংলার উদ্যোক্তারা বার বার চেষ্ট করেও সময় বাড়াতে পারেননি।
২. হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দের অনৈক্য : হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দের অনৈক্য এই উদ্যোগ ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া বাকি নেতারা এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। কেননা অনেক নেতাই এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিল।
৩. কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অসম্মতি : অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠন উদ্যোগের 'পিছনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের অসম্মতি ছিল। বঙ্গীয় প্রদেশের হিন্দু নেতাগণ এই উদ্যোগের ব্যাপারে গান্ধীজিও বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তারা এ ব্যাপারে কোনো সম্মতি প্রদান করেনি । অপরদিকে মুসলিম লীগের মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতাও ছিল এই উদ্যোগে অসম্মত । তাই এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৪. আসামের গুরুত্ব : আসাম ছিল পেট্রোল ও অন্যান্য প্রচুর খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ । তাছাড়াও কৌশলগত দিক থেকে আসাম ছিল অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠিত হলে আসাম ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। তখন ভারতকে আসামের সাথে যোগাযোগ রাখতে হলে বাংলার সাথে ট্রানজিট ব্যাপারে চুক্তি করতে হত। তাই ভারতবাসী অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যা এই উদ্যোগের ব্যর্থতার আরেকটি কারণ।
৫. দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার আশঙ্কা : অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী হ না হওয়ার আশঙ্কার কারণে এই প্রস্তাব বা উদ্যোগ অনেকটা হ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, অখণ্ডভাবে বাংলা রাষ্ট্র যদিও গঠিত হয় তবে তা বেশি দিন স্থায়িত্ব লাভ নাও করতে পারে। কারণ এই রাষ্ট্রের একটি অংশ হবে ভারতপন্থি আর অন্য একটি অংশ হবে পাকিস্তানপন্থি । তাই এই আশঙ্কা সকলের মনেই দেখা দেয় ।
৬. বাঙালি মধ্যবিত্তের অপতৎপরতা : বাংলা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অপতৎপরতা অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠন উদ্যোগকে অনেকাংশেই ব্যর্থ করে দেয়। কেননা বাঙালি নেতারা যখন অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছিল তখন বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি এতে সাড়া দেয়নি এবং অনেকাংশে দায়- সাড়াভাব পোষণ করে। তারা বাংলার বদলে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিল।
৭. কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যর্থতা : কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যর্থতাই অনেকাংশে অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেয়। বাংলার শাসনকার্য ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এক দশক হিন্দুরা কোন ভূমিকা পালনের সুযোগ না পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতি অনেকটাই অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। এই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। যার প্রভাব অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠন উদ্যোগের উপর পড়ে।
৮. জনসম্মুখে উপস্থাপন না করা : ১৯৪৭ সালে যে অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তা ছিল অনেকটাই শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা এ ব্যাপারে জনসম্মুখে তেমন কিছুই উপস্থাপন করেনি এবং এর ফলে জনগণও এই উদ্যোগে তেমন সাড়া দেয়নি। ফলশ্রুতিতে এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনে বাঙালি নেতাদের আগ্রহের ঘাটতি ছিল না। তবুও নানা কারণে তাদের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এক্ষেত্রে বাংলার জনগণের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদেরও দায় কম ছিল না। আর তাই এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হওয়ার ফলে বাংলা তার ঐতিহাসিক অখণ্ডতা ভঙ্গ করে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে পড়ল ।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ ১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম ১৯৪৭ সালের সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাব টি। যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।