পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যসমূহ আলোচনা কর |
পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ ব্যাখ্যা কর
- অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যসমূহ আলোচনা কর।
- অথবা, পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যের শিকার হয় তা তুলে ধর
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশ তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে দু'ধরনের স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতাশীল হয়।
(ক) সামাজিক বৈষম্য :
১. ধর্মীয় ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্ত |ানে ইসলামি সামাজিক ব্যবস্থা চালু থাকলেও ইসলাম সম্পর্কে দুই অংশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্য ছিল। পূর্ব পাকিস্ত ানে ধর্মীয় জীবন ছিল অনেকটা উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল অনেকটা রক্ষণশীল ও গোঁড়া ।
২. জাতপাতের ভিন্নতা : পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ সমজাতীয় ছিল না। এখানকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ও বেলুচিস্তানে উপজাতিদের প্রাধান্যের ফলে কোনো সময় ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে, নৃতাত্ত্বিক সূত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনেকাংশেই সমজাতীয়। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাঙালি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে কিছু কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠী ও আদিবাসী বসবাস করলেও তাদের সংখ্যা ছিল বাঙালি। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংগঠনে তারা কোনো বাধা হয়ে উঠেনি।
৩. প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য : ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান অংশে পুরাতন প্রশাসন বিভাগ ব্যবস্থা মূলত অপরিবর্তিত থেকে যায়। সেখানে এমন কিছু শহর ছিল যেগুলো অতীতে প্রাদেশিক কেন্দ্র ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারি প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারীদের নিয়োগ করে।
৪. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের প্রাধান্য : বাঙালি বুর্জোয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পোদ্যোক্তারা পূর্ব পাকিস্তানে আইনগতভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমঅধিকারী হলেও সেগুলোর ব্যবহারের সুযোগ ছিল অসম। বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থার কারণ ছিল ঋণ পাওয়া ও শেয়ার বিক্রিয় প্রশ্নে বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভরশীলতা। আর এসব প্রতিষ্ঠান ছিল অবাঙালি পুঁজিপতিদের কর্তৃত্বাধীন ।
৫. সামাজিক অবকাঠামোগত বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানের -তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকেও পিছিয়ে ছিল। গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে, কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রের ১৬টির মধ্যে ১৩টিরই অবস্থন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।
(খ) সাংস্কৃতিক বৈষম্য :
১. সাংস্কৃতিক দূরত্বের ব্যাপকতা : পাকিস্তানের দুটি অংশ শুধু যে ভৌগোলিক দিক থেকে ভিন্ন অবস্থানে ছিল তা নয়, দুই অংশের জনগণের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল ব্যাপক সাংস্কৃতিক দূরত্ব। তাদের ভাষা ছিল স্বতন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ভিন্ন। তাদের আহার্যও ছিল ভিন্ন । এমনকি তারা দেখতেও এক রকম ছিল না ।
২. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভিন্নতা : ইসলামি ঐতিহ্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির গভীর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠে ‘ইসলামের নিরাভরণ অথচ অনমনীয়' নীতি সমৃদ্ধ আদলে এবং হিন্দুধর্মের উদার ও গ্রহণযোগ্যতার তীর ঘেঁষে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির প্রকৃতি ছিল অনেকটা গোঁড়া ও একত্ববাদী ।
৩. ভাষাগত দ্বন্দ্ব : পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে যোগাযোগের কোনো সাধারণ ভাষা ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানে অপরিচিত ছিল অপরপক্ষে, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট ভাষা উর্দুতে কথা বলার মতো মানুষ ছিল খুবই নগণ্য ।
৪. বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় প্রতিবন্ধকতা : স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে রোমান হরফে বাংলা লেখার জন্য 'ভাষা সংস্কার কমিটি' গঠন করেন এবং এর অব্যবহিত পরে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেন। ১৯৬৭ সালে বেতারে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয় ।
৫. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা : দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে ২১ মার্চ ১৯৪৮ - সালের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের অপপ্রয়াস চালান ।
(গ) অর্থনৈতিক বৈষম্য :
১. অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৪% জনসমষ্টি বাস করলেও সেখানে জাতীয় সম্পদের ৭৫% বরাদ্দ করার ফলে ঐ অঞ্চলে একদিকে যেমন আয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পায় ।
২. আঞ্চলিক বিনিয়োগ বৈষম্য : ১৯৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট বিনিয়োগের ২১% থেকে ২৬%। ১৯৬০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২% থেকে ৩৬%। অন্যদিকে, রাজস্ব ও উন্নয়ন খাত মিলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয় প্রথম দশকে ৭৪% থেকে ৭৯% এবং দ্বিতীয় দশকে ৬৪% থেকে ৬৮% ।
৩. মাথাপিছু গড় আয়ে বৈষম্য : দেশের দুই অংশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। ১৯৬৪-৬৫ অর্থ বছরের পূর্ব পকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৮১ টাকা। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৪১২ টাকা।
৪. শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৯-৫০ সালে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদনের হার ছিল মোট উৎপাদনের ৯.৪% এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তা উন্নীত হয় ২০% এ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়িত খাত ১৯৪৯-৫০ সালে ১৪.৭% থাকলেও | ১৯৬৯-৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশে।
৫. সম্পদ পাচার : পূর্ব পাকিস্তান থেকে নগদ ও পণ্যে প্রচুর সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। অর্থনীতির ভাষায় একে সম্পদ পাচার বলে । এক হিসেবে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৩,০০০ মিলিয়ন রুপি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয় ।
৬. অভ্যন্তরীণ ঋণ বরাদ্দে বৈষম্য : অভ্যন্তরীণ ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য করা হয়। পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক, পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ কর্পোরেশন, হাউস বিল্ডিংফাইন্যান্স কর্পোরেশন, পাকিস্তান দখলে ছিল ।
৭. আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণ : পাকিস্তানে বহির্বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীভূত দফতর থেকে পরিচালিত হতো। ফলে বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা সর্বদা পশ্চিম পাকিস্তানের দখলে ছিল।
(ঘ) পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক বৈষম্য : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের যাত্রা শুরু পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ভীষণ রকমের রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম যে রাজনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বানচাল ও ক্ষমতা হস্তান্তরের অনীহার মধ্য দিয়ে তা একটি রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ।
(ঙ) শিক্ষাখাতে বৈষম্য : পাকিস্তানের জন্মের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। কিন্তু পাকিস্ত ানের জন্মের পরের দুই দশকে (১৯৪৭-১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। কারণ এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমেছে, আর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় চারগুণ! শুধু যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগত বৈষম্য ছিল তা নয়, বরং দুই পাকিস্তানের শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দেও বিপুল বৈষম্য বিদ্যমান ছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলতে পারি যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মলাভের সাথে সাথেই শাসনকারী এলিটবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সংগত দাবিসমূহ বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রত্যয়সমূহের প্রতি কোনো রূপ সম্মান প্রদর্শন করেনি।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম পাকিস্তান আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।