১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল |
১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল
- অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
- অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব লিখ ।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদে এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল লক্ষণীয়।
নির্বাচনের ফলাফল ছিল ছয়-দফাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় এবং স্বাধীন-সার্বাভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ভিত্তি।
→ ১৯৭০ এর নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল কি না : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল বেশি অবাধ ও নিরপেক্ষ।
তাছাড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে বিভিন্ন দিক থেকে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিচে ৭০ এর নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল কি না তা উল্লেখ করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৬ এর গণপরিষদ, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয়-দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পূর্ব বাংলায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, ১৯৭০ এর নির্বাচনে তা আরো সুদৃঢ় হয়।
নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি চেতনায় স্বাধীন হওয়ার বাসনা-আকাঙ্ক্ষা আরো প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অর্থাৎ জাতীয় চেতনাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।
২. বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয় : ১৯৪৭ সালের পর থেকেই বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যবাদ দাবি করে আসছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা উপায়ে বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবাদকে দমিয়ে রেখেছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির সে স্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয় ঘটে। বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবোধ মানুষ প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৩. আঞ্চলিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : ১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করতে পারেনি আবার পিপিপিও পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করতে পারেনি।
মূলত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও পিপিপি আঞ্চলিক প্রাধান্য লাভ করে। ফলে উভয় দলই এককভাবে কোনো অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব করার বৈধতা হারায়। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান কতৃর্ক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শাসন করার ক্ষমতা অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে জনগণ এর উপর ভিত্তি করে আরো অগ্রসর হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ।
৪. স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ : বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন থেকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল। সরকার এ দাবিকে অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
অবশেষে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের রায় বাঙালিদের ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ করে। ফলে বাঙালি চেতনায় স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক আন্দোলন আরো তীব্রতা লাভ করে।
যার ফলশ্রুতিতে জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজেদের স্বায়ত্তশাসনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে । যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ।
৫. আওয়ামী লীগের গুরুত্ব বৃদ্ধি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুর রহমানের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে।
পরবর্তীতে যেকোনো জাতীয় প্রশ্নে এ দলের নেতৃত্বের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এতে করে জনগণ আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে একতাবদ্ধ হয়।
তাই শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যখন স্বাধীনতার ডাক দেন তখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি তার সাথে ঐক্যমত পোষণ করে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৬. স্বাধীনতার চেতনার জাগরণ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের বিজয় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করে। বিন্দু বিন্দু জলে যেমন- সিন্ধুর সৃষ্টি হয় তেমনি ছোট ছোট বিজয় মহা বিজয়ের পথকে প্রশস্ত করে।
১৯৫২, ৫৬, ৬৬, ৬৯ প্রভৃতি ছোট বিজয়ের শেষ ধাপে ৭০ এর নির্বাচনের বিজয় ছিল অনুরূপ মহাবিজয়ের পথপ্রদর্শক। এ বিজয়ের দ্বারা তাড়িত হয়ে জনগণ মহাবিজয়ের নিমিত্তে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৭. পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বের অবসান : এ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে ।
পূর্ব পাকিস্তান তখন শেখ মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে, যা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য ছিল চরম অবমাননাকর ও ঈর্ষণীয়।
এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ আরো বড় বিজয়ের দিকে ধাবিত হতে থাকে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
৮. সংগ্রামী মনোভাবের সৃষ্টি : ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাব গড়ে উঠে।
শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। অর্থাৎ ৭০ এর নির্বাচনের দ্বারা সৃষ্ট সংগ্রামী মানসিকতা বাঙালি জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে উৎসাহিত করে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
৯. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি : শোষিত, লাঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত পূর্ববাংলার জনমনে ১৯৭০ সালের নির্বাচন আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
১৯৪৭ সালের পর থেকে বাঙালি পদে পদে কারণে-অকারণে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হয়ে আসছিল কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও তার সফলতা খুব কমই এসেছে।
কিন্তু ৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয় বাঙালি জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাসকে আরো সূদৃঢ় করে। আর-এ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়েই বাঙালিরা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১০. অধিকার সচেতনতা : পূর্ববাংলার জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি, ব্যবসা- বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রেই বঞ্চিত ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার অধিকার বঞ্চিত জনগণ সর্বপ্রথম অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ অধিকার সচেতনতা বাঙালি জনগণকে মুক্তি সংগ্রামের পথে পরিচালিত করে।
ফলে ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথকে প্রশস্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ।
১১. শোষণ থেকে মুক্তির চেতনা অর্জন : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান । সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জণগণের উপর বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে।
এই শোষণের প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন বাঙালি জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন, শোষণ থেকে মুক্তির আগ্রহকে বলিষ্ঠতর করে তোলে।
নির্বাচনের ফলাফল এ চেতনাকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করে যা জনগণকে মুক্তির মানসিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রচনার পথকে আরো বিস্তৃত করে ।
১২. বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে প্রভাব : নির্বাচনের পূর্বে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনে বিজয়ী দল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ গঠন করবে এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক সংবিধান = প্রণয়ন করবে।
কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ায় শুরু - হয় ষড়যন্ত্র। ফলে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।
তার এ ঘোষণা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল বাঙালি জাতি তা সুস্পষ্টই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তারা এটাও উপলব্ধি করলো যে, যুদ্ধের মাধ্যমেই তাদেরকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বাঞ্চলে শাসন করার বৈধতা হারায়।
অপরপক্ষে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরো সুদৃঢ় করে। অবশেষে পশ্চিমা শাসকবর্গ আওয়ামী লীগের বিজয়কে অস্বীকার করলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয় হয়।
তাই বলা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।