পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর জেনে নিবো। তোমরা যদি পড়াটি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর |
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর
- অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্যগুলো বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৈষিম্য ছিল চরম পর্যায়ে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল বাঙালিরা কিছু মানে না, বোঝে না। তারা কোনোকিছুর যোগ্য নয়। তাই নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যই সমান সই। এ উপলব্ধি থেকেই তারা সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করেছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ছিল প্রকট আকারের।
→ রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য এবং শোষণ ও শাসন করার জন্য শুরু থেকেই রাজনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন শুরু করে। নিম্নে তাদের রাজনৈতিক বৈষম্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. লাহোর প্রস্তাবের দাবি উপেক্ষিত : মূল লাহোর প্রস্তাবে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কূটকৌশল অবলম্বন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসী পূর্ব-বাংলার অধিবাসী ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-বাংলার অধিবাসীদের রাজনৈতিক মর্যাদা না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোমুখি করে রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করা হয় পাকিস্তানের রাজধানী। এছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়। ফলে লাহোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়।
২. পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কূটকৌশল : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের উল্লেখ থাকলেও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় উল্লিখিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এমতাবস্থায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী পূর্ব-বাংলার হওয়া সত্ত্বেও তাদের রাজনৈতিকভাবে মর্যাদা না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা কৌশল ঠিক করেছিল কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত রাজনৈতিক কার্যাবলিই পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে।
৩. প্রতিনিধিত্বের বৈষম্যের চিত্র : জন প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল ব্যাপক আকারের। তৎকালীন সময়ের মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৯৫ জন। আর নয়জন সরকার প্রধানের মধ্যে ৩ জন ছিলেন পূর্ব-বাংলার এবং এর মধ্যে | নাজিমুদ্দীন ছিলেন উর্দু ভাষী যদিও মাত্র ১ বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তাকে বহিষ্কার করেন। আর সময়ের হিসেবে ২৪ বছরের মধ্যে ৬ বছর (২৫% সময়) বাংলাদেশের নাগরিকতা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছে। জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হলেও তার শাসনামলে মন্ত্রিসভার মোট ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২২ জন (৩৫.৪৮%) আর এসব বাঙালিদের মধ্যে কেউ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাননি। তারা বাঙালিদের এমন পদে দিত যেখান থেকে শুধু সান্ত্বনা ছাড়া আর কোনো কিছু জোটত না। বাঙালি জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার পর প্রতিনিধি কম এটা একটি বিশাল বৈষম্য ।
৪. সংবিধান প্রণয়নে শাসক শ্রেণির অনীহা : ১৯৪৭ সালে নতুন রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা নিজ নিজ দেশের সংবিধান প্রণয়নের কথা উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয় ১৯৫৬ সালে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি পাকিস্তানের অনীহার কারণে প্রথম সংবিধান প্রণীত হতে সময় লেগেছিল নয় বছর। পূর্ব বাংলার যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এ সংবিধানে পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দেওয়া হয়। পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এ সংবিধানে সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিদের পশ্চিমাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও যুক্ত নির্বাচনের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়।
৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব : পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতি বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। মুসলিম লীগের দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, বাঙালি-অবাঙালি বৈষম্য নীতি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা কতিপয় উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে “আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে । কিন্তু ক্ষমতাসীন দল নব গঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ যে নানাভাবে কটাক্ষ করে। তারা চেয়েছিল যাতে বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি রাজনীতিতে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তারা আরো বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে।
৬. পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধির প্রতি অবহেলা : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও সমমনা দলসমূহ যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার গঠন করে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র এ মন্ত্রিসভাকে সফল হতে দেয়নি। ২ মাসের মধ্যেই মন্ত্রিসভাকে বাতিল করে পূর্ব বাংলার কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে । তাদের লক্ষ্য ছিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে জনগণের সম্মুখে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত করা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অনীহা ভাব জাগিয়ে তোলা ।
৭. বাঙালি নেতৃবৃন্দের প্রতি কঠোর দমননীতি : ১৯৫৮ সালে ক্ষমতাসীন আইয়ুব খান গণতন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী ছিলেন। তিনি যে দশ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেছেন এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতাই কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৬০ এর দশকের শেষার্ধে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য নেতৃবৃন্দকে অন্যায়ভাবে জেলে রাখেন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের পরামর্শ বা মতামত ছাড়াই তাদের উপর এক অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেন। শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তাদেরকে সরকার গঠনের রাজনৈতিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। তারা এভাবে বাঙ্গালি নেতৃবৃন্দের প্রতি কঠোর নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে দমন করতে চেষ্টা করে। তারা এভাবে রাজনৈতিক চরম বৈষম্যের স্বীকারে পরিণত করেন পূর্ব বাংলার জনগণকে। পরবর্তীতে যা তাদের পতনের মূল কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল ।
৮. গুরুত্বপূর্ণ পদ হতে বঞ্চিত : ষাটের দশকে বাঙালিদের প্রবল আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে দু'জন বাঙালিকে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিষদ সচিবালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব করা হয়। আবার ১৯৬৬ সালের ৬- দফাভিত্তিক আন্দোলন শুরু হলে আরো চারজন বাঙালিকে সচিব নিযুক্ত করা হয়। তবে বাঙালিদের স্বরাষ্ট্র, অর্থ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এখানে উচ্চ পদের সিংহভাগই অবাঙালি নিযুক্ত করা হতো। সম্পদের ভাগাভাগিতে বাঙালিদের অধিকার সম্বন্ধে যেন কেউ কোনো কথা বলতে না পারে, সেজন্য বাঙালিদের কোনো সময় অর্থ পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়োগ করা হতো না।
৯. কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়োগ বৈষম্য : তৎকালিন পাকিস্তানি বাঙালিদের প্রত্যেকটি বিভাগেই বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছিল। যেমন বেসামরিক উচ্চপদ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাঙালি প্রতিনিধিত্ব এক দিকে যেমন কম ছিল, অন্যদিকে তেমনি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও ছিল সীমিত। ১৯৬৬ সালের এক হিসাব থেকে এ বৈষম্যের চিত্র আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ১৩টি কর্পোরেশনের মধ্যে মাত্র একটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাঙালি । অন্যদিকে ১৯৬৩ সালের এক হিসেবে জানা যায় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মাত্র ৩.৪% বাঙালি নিযুক্ত ছিলেন।
১০. বিদেশি মিশনে বৈষ্যম্যের চিত্র : বিদেশে পাকিস্তানি মিশনগুলোতেও একই ধরনের বৈষম্য বজায় থাকে। বিদেশে পূর্ব পাকিস্তানিরা উচ্চ হারে তাদের বৈষম্যের স্বীকার হয় । বিদেশে পাকিস্তানি মিশনগুলোতে ৮৫% কর্মকর্তা কর্মচারী পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ১৫% ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি। বিদেশে পাকিস্তানি ৬৯ জন রাষ্ট্রদূতের মধ্যে ৬০ জন দূত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। ১০৪ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে ৩০ জন ছিলেন বাঙালি । দ্বিতীয় শ্রেণির নন গেজেটেড ২০৪ জনের মধ্যে বাঙালি ছিলেন ৫৫ জন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের জনসংখ্যা অনুপাতে কমসংখ্যক নিয়োগ ছাড়াও প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় নিয়োগ, বদলি ও বেতনের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হতো।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল বৈষম্যের কালো ছায়া। পূর্ব বাংলার জনগণ যে পরিমাণ বৈষম্যের স্বীকার হন তা ছিল অবর্ণনীয় প্রশাসনিক বৈষম্য বাঙালিদের আন্দোলনের পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করে। তারা তাদের অধিকারসমূহ আদায় করতে সচেষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, বৈষম্য নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার হতে বঞ্চিত করে। প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্য তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালিদের রাজনীতি হতে দূরে রাখা। কিন্তু তারা বাঙালিদের প্রতি জুলুমের পরিমাণ এতোই বাড়িয়ে দেয় যাতে বাঙালিরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
→ সামরিক বৈষম্য : পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে দিন দিন পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হয়, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। নিম্নে পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সামরিক বৈষম্য আলোচনা করা হলো :
১. সুশৃঙ্খল সামরিক আমলাতন্ত্র : পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে এক সুশৃঙ্খল আমলাগোষ্ঠী লাভ করে। ব্রিটিশ আমলে এ আমলাগোষ্ঠীই ছিল প্রশাসনের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল আমলাগোষ্ঠী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ আমলাশ্রেণি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং তারা সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে ।
২. পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিস : ১৯৪৭ সালে মুসলমান ICS অফিসারদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন পাঞ্জাবি, অবশিষ্টরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত অবাঙালি রিফুজি মুসলমান। আর এদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস। তারা পাকিস্তান প্রশাসনের উচ্চতম পদগুলো দখল করেন। স্বভাবতই স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই পাকিস্তান প্রশাসনে অবাঙালি মুসলমানদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। ১৯৪৭ এরপর ১৫ জন প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সদস্যকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখানেও পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে। এখানে ১৫ জনের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৪ জন। বাঙালির পরিবর্তে বাঙালিদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে।
৩. রাজনীতিতে প্রভাব : আইয়ুব খান ছিলেন একজন সরকারি আমলা। তিনি ক্ষমতা দখল করে প্রকাশ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রকৃত গণতন্ত্রকে হত্যা করেন। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করেন।
৪. সামরিক শাসনে সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব : পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সামরিক আমলাদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সামরিক শাসনের ১৯৪৪ সালে ৭৯০ জন জুনিয়র গ্রেড কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিল মাত্র ১২০ জন। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৬০ সালের মে মাস পর্যন্ত ৯ মাসে ৭৩৪ জন সেকশন অফিসার নিয়োগ করা হয়। যার মাত্র ৭৪ জন পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৫৯-১৯৬৩ সময়কালে রাওয়াল পিন্ডিস্থ কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের ৩১৫ জন কেরানি নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানি ছিল মাত্র ৩৬ জন ১১%। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সময়কালের মধ্যে ১৪ জন সামরিক কর্মকর্তাকে বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা সকলেই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্ত ানি অর্থাৎ পাকিস্তানি প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করেন যেসব সামরিক কর্মকর্তা তাদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানি ।
৫. প্রতিরক্ষা বিভাগে প্রভাববিস্তার : প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল শাখার সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিরক্ষা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোও ছিল সেখানে। প্রতিরক্ষা বিভাগে নাম লেখাতেই চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৬ থেকে ২০ বা ২২ বছর মাতৃভূমি ছেড়ে হাজার মাইল দূরে যাওয়ার আগ্রহ খুব কম পূর্ব পাকিস্তানির ছিল। আবার ইচ্ছা থাকলেও প্রতিরক্ষা সার্ভিসে নিয়োগ লাভ বাঙালিদের জন্য ছিল বেশ কঠিন। রিক্রুটিং বোর্ডগুলো গঠিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে। তারা সহসা বাঙালিদের অফিসার পদে নিয়োগ দিত না। এমনকি জোয়ান পদে নিয়োগর জন্য যে দৈহিক মাপ ও গঠন নির্ধারণ করা হয়েছিল তা খুব কম বাঙালির ছিল। ফলে প্রতিরক্ষা বিভাগে একমাত্র প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আমলারা। তারা দেশের ভালো-মন্দের কোন ভ্রূক্ষেপ না করে ইচ্ছামতো অনেক সিদ্ধান্ত নিত।
৬. সেনা বাহিনী : তৎকালীন আমলাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে তাদের | মধ্যে সবার আগে যাদের নাম আসে তারা হলো সেনাবাহিনী। আর এ সেনাবাহিনী ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে যেখানে বাঙালিদের খুব কমই চাকরি দেওয়া হতো। ১৯৬৬ সালে দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মোট ১৭টি উচ্চ পদস্থ সামরিক পদের মধ্যে সেনাবাহিনীর জেনারেল ২টি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও ১৪টি মেজর জেনারেলের মধ্যে মেজর জেনারেল পদে ছিলেন মাত্র একজন বাঙালি। সামরিক অফিসারদের মধ্যে ৫% ছিলেন বাঙালি আর বাকি ৯৫% ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। শুধু অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে না সাধারণ সৈনিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাঙালিদের সুযোগ ছিল সীমিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৫০,০০০ সদস্যের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২০,০০০ এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি প্রশাসনে একচ্ছ আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আমলারা ।
৭. নৌবাহিনী : নৌবাহিনীতে ১৯% টেকনিক্যাল লোক ছিল বাঙালি এবং বাকি ৮১% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। নন টেকনিক্যাল লোকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন ৯%।
৮. বিমান বাহিনী : ফলে পশ্চিম বিমান বাহিনীতে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি সংকীর্ণতা গ্রহণ করা হয়। এ বাহিনীতে মাত্র ১১% বাঙালি পাইলট অফিসার এবং ১:৭% বাঙালি টেকনিশিয়ান ছিলেন। পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের মোট ৭২৮০ জন লোকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২৮০ জন এবং পি.আই এর ১০ জন পরিচালকের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন এবং ৫. জন এরিয়া ম্যানেজারের সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্ত ানি। পাকিস্তান এয়ার লাইন্সের ১০৩ জন বিমানবালার মধ্যে মাত্র ৪ জন ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীতেও আমলারা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
৯. পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের সরকারের তোষামোদ : বেসামরিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা প্রথা ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে বর্ধিত বাঙালি নিয়োগ করার ব্যাপারটি সম্ভবপর করে তুললেও সামরিক বাহিনীতে অনুরূপ নীতি না থাকায় সেক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই সামান্য। উল্লেখ্য সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি আধিপত্য নিশ্চিত করতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে প্রাদেশিক কোটা নির্ধারণ করা হয়। এতে ৬০% পাঞ্জাবি, ৩৫% পাঠান এবং বাদবাকি ৫% পশ্চিম পাকিস্তান ও অন্যান্য এলাকা ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগ করার বিধান চালু করা হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৩ বছরে সামরিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্যে বাঙালিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদেশি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ রাখা হতো। আর এ বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর । যদি তোমাদের আজকের এই পড়াটিটি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।