একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজকে বিষয় হলো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা জেনে নিবো। তোমরা যদি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা টি ভালো ভাবে নিজের মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমাকে মনযোগ সহকারে পড়তে হবে। চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমরা জেনে নেই আজকের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা টি।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা |
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা
আমি উম্মে কুলসুম। আমার বাবার বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা থানায় । সেখানেই আমার শৈশব কেটেছে। কিছুদিন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে মামার বাড়িতে ছিলাম। এরপর ছিলাম দিনাজপুরে চাচার বাড়ি। সেখানে সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। ১৯৭১ সালের কথা বলছি। আমার ছোটবোন আনোয়ারার বিয়ে হয়। দিনাজপুর শহরের গোলকুঠিতে। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা সপরিবারে সেখানে যাওয়ার পর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাঙালিরা অবাঙালিদের আর অবাঙালিরা বাঙালিদের পেলেই মেরে ফেলছে। দিনাজপুর শহরের গোলকুঠি ছিল অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। তাই আমরা সেখান থেকে পালিয়ে প্রথমে গেলাম পুলহাট তারপর খানপুর এলাকায়। এখানে কয়েকদিন থাকার পর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে খানপুর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ থানার হামজাপুর হয়ে গঙ্গারামপুরে উপস্থিত হলাম। সেখানে কয়েক ঘণ্টা রাস্তার ওপর আশ্রয়হীনভাবে ছিলাম। তারপর এক চিকিৎসকের কোয়ার্টারে আশ্রয় নিলাম। প্রায় তিন মাস সেখানে থাকার পর পরিচিত এক ছাত্রের সাহায্যে প্রথমে ধলদিঘী তারপর পশ্চিম দিনাজপুর যাই। সেখানে রহমান নামক একজন কৃষকের বাড়িতে উঠি। সেখান থেকে প্রায়ই নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যাতায়াত করতাম। পরিচিত লোকজনদের সন্ধান করতাম। হঠাৎ করে একদিন হাজী মোহাম্মদ দানেশের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন— তুই আমাদের সাথে কাজ করবি?' আমি তখন কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম— 'হ্যাঁ করব'। তিনি আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। কাজ হলো ক্যাম্পের ভেতরে ঝাড়ু দেওয়া। অসুস্থ লোককে সেবা করা। পিস্তল, গ্রেনেড ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছানো। হাজী মোহাম্মদ দানেশ সতর্ক করে দেন— ‘এই কাজের কথা কাউকে বলা যাবে না, নিজের আত্মীয়স্বজনের কাছেও না। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়লেও কোনো তথ্য ফাঁস করা যাবে না।'
প্রথমে আমি বালুরঘাট হাসপাতালে আহত রোগীদের সেবা দানের কাজ করতাম। রোগীদের শুশ্রূষা করা, ইনজেকশন দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, এগুলো ছিল আমার প্রতিদিনকার কাজ। আমার সঙ্গী হিসেবে ছিল বগুড়ার ছায়াবাণী ও পাবনার শিবানী রায়সহ আরও অনেকে। আমি চিরিরবন্দর উপজেলার মোহনপুর এলাকার ধীরেনসহ আরও অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধার সেবা করেছি। আজ আর সবার নাম মনে নেই । তবে এক শিখ ফৌজের কথা বারবার মনে পড়ে। শিখ ফৌজের পায়ে গুলি লেগেছিল। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । প্রায় তিন মাস চিকিৎসার পরও পাসহ তাঁর সমস্ত শরীরে পচন ধরে এবং তিনি মারা যান। আহত শিখ মুক্তিযোদ্ধা যেদিন মারা যান সেদিন তাঁর একটা আবদার ছিল আমার কাছে। আমাকে কমলা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি কমলা খেতাম না। তাই কমলা খাওয়াতে পারিনি। আরও একটা আবদার তিনি আমার কাছে করেছিলেন। আমার কাছে একটি অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন। আমি বললাম, 'অটোগ্রাফ! কী করবেন?' শিখ মুক্তিযোদ্ধা কষ্টক্লান্ত কণ্ঠে আমাকে বলেন— ‘আপনার অটোগ্রাফ আমার বুকে রেখে দেব । আর মনে করব, আমার এক সিস্টার আছে, যাঁর অটোগ্রাফ আমার বুকের মধ্যে আছে।' আমি তাঁকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম । তিনি আমাকে এজন্য একটি কাঠের কলম উপহার দেন। আমি অটোগ্রাফ দিয়ে কাগজটি তাঁর বুকের ওপরে রাখি। আর সেদিনই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কারণ আমি সেদিন তাঁর কমলা খাওয়ার ছোট্ট আবদারটি পূরণ করতে পারিনি। আর সেই না পারাটাই আমাকে আজও তাড়িত করে ।
আমি হাসপাতালে তিন মাসের মতো সেবিকার কাজ করেছি। তারপর গ্রেনেড বহনের কাজ শুরু করি। প্রথমে বালুরঘাট হাসপাতাল থেকে গ্রেনেড নিয়ে যাই হাসপাতালের পূর্ব দিকে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পে। এরপর আমি বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র বহন করে নিয়ে যেতাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছে দিতাম। কাজটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নতুন মাটির হাঁড়ির ভেতরে গ্রেনেড় বহন করে নিয়ে যেতাম। বিস্ফোরক ভর্তি হাঁড়ির ভেতর খড় থাকত, মুখে কলা পাতা, শাল পাতা দিয়ে ঢাকা থাকত। হাঁড়ির গলা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত। ওই দড়ি ধরে মিষ্টির হাঁড়ির মতো ঝুলিয়ে নিয়ে যেতাম। বিস্ফোরক বহনের সময় আমার পরনে থাকত সাধারণ কাপড়, পায়ে থাকত চপ্পল। আমাকে একেবারে গ্রামের সাধারণ মেয়েদের মতো লাগত। আমার চেহারা এমন ছিল যে কেউ কেউ আমাকে খ্রিষ্টান বলত। কেউ কেউ সাঁওতালও বলত। বালুরঘাট থেকে বিস্ফোরক নিয়ে আমি শালবাগানে যেতাম। সেখানে সাঁওতালদের বাড়ি ছিল। আমি বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়ার সময় ভারতীয় সৈন্যরা আমাকে ফলো করত। এটা বুঝতে পারি একদিন পানির পিপাসা পেয়েছিল। আমি এক বাড়িতে জল চাইতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘এখানে কোথায় এসেছেন?' আমি বললাম— ‘ডিম নিতে'। পরে ক্যাম্পে ফিরে গেলে এই ব্যাপারটিই আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— 'আমি কোথায় গিয়েছিলাম?' ক্যাম্পে 'আমরা অনেক কথাই সাংকেতিক ভাষায় ব্যবহার করতাম। যেমন, হয়তো আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো কেউ এসেছিল কি না? আমি এর জবাবে হ্যাঁ অথবা না বলতাম। আমি শালবাগানে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিস্ফোরক তুলে দিতাম। যার হাতে বিস্ফোরক তুলে দিতাম তাকে আমি অবশ্যই চিনতাম। একজন ছিল সৈকত পাল। অন্যজন ভিক্টর। আরেকজন সাঁওতালকেও দিতাম। তারা ছিল স্থানীয়। ওরা যখন আমার কাছ থেকে বিস্ফোরক নিত, তখন তারা সাদা কাগজে সই করে নিত। সই করার সময় তাদের নাম ও সাংকেতিক নম্বর লিখত। আমি শালবাগান ছাড়াও আরও অনেক জায়গায় গ্রেনেড নিয়ে যেতাম।
যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে কখনো বিপদে পড়িনি। কেউ সন্দেহও করেনি। গ্রেনেড নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বলে দিত— ‘পড়ে গেলে বা ধাক্কা লাগলে গ্রেনেড ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে।' এতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু আমি ভয়ে ভীত না হয়ে কাজ করেছি। আমি প্রায় পাঁচ মাস এ কাজ করেছি। নেতারা আমাকে পয়সা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি নিইনি। তাঁরা আমাকে কাজ দিয়েছিলেন; আমি স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করতে পেরেছি— এটা আমার জীবনের বড় পাওয়া। হাজী মোহাম্মদ, দানেশ ভাই, শিখ ভাই আমাকে মায়া, মমতা দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন সেটাই আমার পারিশ্রমিক। তাছাড়া দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে পেরেছি এর চেয়ে বড় সার্থকতা আর কী হতে পারে। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি গর্ব করে বলতে পারি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ।
আর্টিকেলের শেষকথাঃ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা
আমরা এতক্ষন জেনে নিলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা টি। যদি তোমাদের আজকের এই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রচনা টি ভালো লাগে তাহলে ফেসবুক বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে দিতে পারো। আর এই রকম নিত্য নতুন পোস্ট পেতে আমাদের আরকে রায়হান ওয়েবসাইটের সাথে থাকো।